বিগত চার দশকে একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পেছনে আমাদের যে যাত্রা তার মূলে রয়েছে শিল্পের অভাবনীয় বিকাশ, কিন্তু পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধির দিকে যাবো কিনা, এখন তা নির্ধারণ করার সময় এসেছে। কেননা সম্পদের অবক্ষয় শুধুমাত্র আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কিংবা প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, বরং ভবিষ্যতকেও চরম ঝুঁকিতে ফেলবে। টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়, সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতা ও সচেতনতা বাড়াতে আরো বিনিয়োগ করা জরুরি। সম্পদে পরিণত করতে বিশ্বে এখন এক শিল্পের বর্জ্য আরেক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি কোনো পণ্য ব্যবহারের পরও তা ব্যবহৃত হচ্ছে অন্য পণ্য তৈরির উপকরণ হিসেবে।
টেকসই অর্থনীতির জন্য বাংলাদেশকেও বৃত্তাকার অর্থনীতির পথে যেতে হবে। সার্কুলার ইকোনমির সঠিক বাস্তবায়নে চাহিদা ও যোগানের সমন্বয়ের জন্য অ্যাকাডেমিয়া, শিল্পখাত ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করা প্রয়োজন। আমাদের শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। বিশেষ করে আমাদের গার্মেন্টস শিল্প নানা সংস্কার, পরিবর্তন এবং রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক বাধা, বিপত্তি প্রতিকূলতা, ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে আমাদের গার্মেন্টস খাতকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এখন পরিবেশ সুরক্ষার দিকে সবাইকে আলাদা মনোযোগ দিতে হচ্ছে। গার্মেন্টস সামগ্রী ক্রেতা দেশ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, গোষ্ঠী এখন গার্মেন্টস উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশবান্ধব, শ্রমিকবান্ধব নানা শর্ত আরোপ করছে। যে সব শর্ত পূরণের মাধ্যমেই কেবল তাদের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। আর এ জন্য এখন গার্মেন্টস শিল্পে কমপ্লায়েন্সকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। অতীতে এ বিষয়টিকে এক প্রকার অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
গ্রিন ইকোনমি বা সবুজ অর্থনীতির শ্লোগান দিনে দিনে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পরিবেশবান্ধব শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের উদ্দেশ্যেই এখন নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এ জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশকে উপেক্ষা করে উন্নত সমৃদ্ধ সমাজ, অর্থনীতি, সুন্দর জীবন যাপনের কথা ভাবা যায় না। সুন্দর অনুকুল পরিবেশ উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশ যদি বিপন্ন হয়, তাহলে অর্থনীতিও বিপন্ন হয়। যার প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামগ্রিক সমৃদ্ধির জন্য পরিবেশগত ভারসাম্য ও অনুকুল প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি এখন জোর দিচ্ছেন সবাই। অতীতে এ বিষয়ে তেমন কোনো সচেতনতা ছিল না। কিন্তু বিশ্বব্যাপী শিল্পায়ন ও নগর সভ্যতার ক্রম বিকাশের প্রভাবে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি এবং ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটায় এখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ বিষয়ে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজণিত কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ যখন হুমকির মুখে পড়েছে তখন গ্রিন ইকোনোমির ধারণা জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য সবুজ অর্থনীতির নানা কর্মকৌশল কার্যকর ও সুফলদায়ক হিসেবে প্রমাণিত হওয়ায় এখন বাংলাদেশে এ বিষয়ে মনোযোগী হয়ে উঠেছেন সবাই। যেসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র উৎপাদন, বণ্টন এবং সেবা ও পণ্যের ভোগকে কেন্দ্র করে আবর্তিত না হয়ে দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব না ফেলে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত হয় সেগুলোকে গ্রিন ইকোনোমির অন্তর্ভূক্ত করা যায়।
গ্রিন ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার জন্য সবার আগে প্রয়োজন সুপরিসর জায়গা। ঘিঞ্জি পরিবেশে সীমিত পরিসরে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে যে পরিমাণ জমির উপর কারখানা হবে তার অর্ধেকটাই ছেড়ে দিতে হবে সবুজায়নের জন্য। যেখানে সবুজ বাগান থাকবে। কারখানার চারপাশে খোলা সুপরিসর জায়গা থাকবে। আর কারখানার ভেতরেও থাকবে খোলা জায়গা। শ্রমিকদের কাজের পরিবেশও হবে সুন্দর। একজন শ্রমিক থেকে আরেকজনের দুরত্ব হবে বেশ। এ ছাড়া সব কিছুই অটোমেশনে সম্পন্ন হবে। সব যন্ত্রপাতি হবে অত্যাধুনিক। ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ব্যবস্থা থাকবে সেখানে। থাকবে সোলার প্যানেল, এলইডি বাতি। এ ছাড়া পানি রিসাইক্লিনিং হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শ্রমিক কর্মচারী কর্মকর্তারা সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পাবেন। কারখানার ভেতরে আলাদাভাবে তাদের বাসস্থানের সুযোগ থাকবে। শ্রমিকদের যাতায়াতের জন্য থাকবে বিশেষ সুবিধা। চিকিৎসাভাতাসহ রেশনিংয়েরও ব্যবস্থা থাকবে। এ ধরনের কারখানায় শ্রমিকদের জন্য লাইফস্টাইল সেন্টার, শিশুদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার ও খাবারের জন্য ডাইনিং কক্ষ, মসজিদ অথবা নামাজঘর এবং প্রশিক্ষণ ক্লাসের বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে। পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার ফলে শতকরা ২৪ শতাংশ জ¦ালানী সাশ্রয় হয়। অন্যদিকে ৫০ শতাংশ পানির অপচয়ও কমে।
শিল্প ও সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর উৎপাদন ও শিল্প উন্নয়নের পাশাপাশি ইকোসিস্টেমের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা অতীব প্রয়োজনীয়। পরিবেশবান্ধব স্থাপনার বিভিন্ন নির্ণায়কের মধ্যে রয়েছে- টেকসই নির্মাণ ভূমি, জ্বালানি দক্ষতা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, নিরাপত্তা, পানি ব্যবহারের দক্ষতা, কর্মবান্ধব পরিবেশ, অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত মান, কারখানার অভ্যন্তরে বায়ুর মান, প্রযুক্তির ব্যবহার, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, দুর্ঘটনা মোকাবিলার সক্ষমতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। একটি পরিবেশবান্ধব শিল্প কারখানায় উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে পানি, বিদ্যুৎ, রং এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব উপায়ে হচ্ছে কিনা তা দেখা হয়। অধিকাংশ শিল্প কারখানা ইটিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে গতানুগতিক ইটিপির পরিবর্তে বায়োলজিক্যাল ইটিপি ব্যবহার করছে, যা আমাদের সবুজ বিপ্লবেরই একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত। বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে টেকসই উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান আরো সুদৃঢ় করে তুলতে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় মনোযোগী হতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে অর্থায়নের পাশাপাশি এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল ও করপোরেট গভর্ন্যান্স (ইএসজি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকে আরো গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের টেকসই ও স্বল্প কার্বনফুট প্রিন্ট সম্পন্ন পোশাকের প্রতি আগ্রহ ক্রমশ বেড়ে চলেছে এবং জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরির নিত্যনতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে কনজুমারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের শিল্প কারখানার মালিকরা এখন এসব বিষয়ে খুব সচেতন হচ্ছেন। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আগ্রহী হয়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। এরই মধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান পানি ও গ্যাস সাশ্রয়ে ইতিবাচক ব্যবস্থা নিয়েছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে এক নীরব সবুজ বিপ্লব ঘটেছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর ব্যাপক প্রচার হয়নি এখনো। ফলে, এটির ব্র্যান্ডিং হয়নি তেমনভাবে। বাংলাদেশ বর্তমানে পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি স্থাপনে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে। আমাদের গার্মেন্টস শিল্প নানা সংস্কার, পরিবর্তন এবং রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর্থিক ক্ষেত্রে গ্রিন ব্যাংকিং ধারনার বিকাশ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে যা দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। টেকসই অর্থনীতির জন্য গ্রিন ব্যাংকিং ধারণার অনুসারী হয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে। যার চমৎকার ফলাফল ক্রমেই অর্থনীতিতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একইভাবে গার্মেন্টস শিল্পে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারনার পরিপূর্ণ বিকাশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে আরো এগিয়ে নেবেÑ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। গ্রিন ফ্যাক্টরি কার্যক্রমকে বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের ব্যাপারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ ক্ষেত্রে চমৎকার গতির সঞ্চার হবে আশা করা যায়। বাংলদেশে গার্মেন্টস খাতে গ্রিন ফ্যাক্টরির প্রচলন বাড়লে বিদেশি ক্রেতারা আগের তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকবেন এদেশে প্রস্তুত গার্মেন্টস সামগ্রী ক্রয়ের প্রতি। এদেশের লাখ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকের জীবন পাল্টে যাবে। বর্তমানে আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের যে সব চ্যালঞ্জ রয়েছে তা গ্রিন ফ্যাক্টরির মাধ্যমে মোকাবেলা করা সম্ভব। এখন অনেকগুলো বৃহৎ শিল্প গ্রুপ তাদের কারখানগুলোকে গ্রিন ফ্যাক্টরিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। রানা প্লাজা ধস এবং তাজরিন গার্মেন্টসের অগ্নি দুর্ঘটনার পর আমাদের গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথাবার্তা প্রচারিত হয়েছিল। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের প্রেসক্রিপশন মেনে সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে কারখানাগুলো নিরাপদ সনদ লাভ করেছে। এখন দুর্ঘটনাও কমেছে। গার্মেন্টস খাত নিয়ে ইতিবাচক ভাবমুর্তি গড়ে উঠেছে। অর্জনটিকে ধরে রাখতে হলে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে আরো।
বাংলাদেশের তৈরি গার্মেন্টস পণ্য আজ বিশে^র দরবারে প্রশংসা অর্জন করছে। প্রায় শতাধিক দেশে বাংলাদেশে প্রস্তত পোশাক সুনামের সঙ্গে রপ্তানি হচ্ছে। করাখানাগুলোতে শতভাগ কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে সারা বিশে^ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে। বাড়বে রপ্তানিও। এর মধ্যে দিয়ে আমাদের গার্মেন্টস খাতে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে রূপকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে, তার লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের গার্মেন্টস শিল্পে কর্মপরিবেশ নিরাপত্তায় অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এতোদিন যাবত এমনভাবে প্রচারণা চালানো হয়েছে যে, আমাদের বেশিরভাগ গার্মেন্টস কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ।
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ