বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণের মতো আরেকটি দূষণ হচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ। প্লাস্টিকের ব্যাপক ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্লাস্টিক দূষণ হলো পরিবেশ কর্তৃক প্লাস্টিক পদার্থের আহরণ, যা পরবর্তী সময়ে বন্যপ্রাণী, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, এমনকি মানবজাতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। আকারের ওপর ভিত্তি করে মাইক্রো, মেসো, অথবা ম্যাক্রো বর্জ্য এই তিন ভাগে প্লাস্টিক দূষণকে শ্রেণীকরণ করা হয়। নিয়মিত প্লাস্টিক পদার্থের ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিক প্লাস্টিক, গৃহস্থালি প্লাস্টিক ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশিরভাগই পুনঃচক্রায়ন হয় না। এগুলো পরিবেশে থেকে বর্জ্যরে আকার লাভ করে। মানুষের অসচেতনতাই প্লাস্টিক দূষণের প্রধান কারণ বলে বিবেচনা করা হয়। প্লাস্টিক এমন এক রাসায়নিক পদার্থ, যা পরিবেশে পচতে অথবা কারখানায় পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করতে প্রচুর সময় লাগে। তাই একে অপচ্য পদার্থ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। সাধারণত উদ্ভিদকূল, জলজ প্রাণী ও দ্বীপ অঞ্চলের প্রাণীরা প্লাস্টিক বর্জ্যরে জন্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্লাস্টিক বর্জ্য ওইসব প্রাণীর বাসস্থান, খাদ্য সংগ্রহের স্থান ও উদ্ভিদের খাদ্য গ্রহণের পথে বাধার সৃষ্টি করে। শুধু উদ্ভিদ বা জলজ প্রাণী নয়, মানুষ প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণের জন্য প্লাস্টিক দূষণ পরোক্ষভাবে দায়ী। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর পাঁচ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে এবং জনসেতনতার অভাবে এক্ষেত্রে আমরা পুরোপুরি সফল হতে পারছি না।
সাধারণত প্লাস্টিক দূষণের জন্য দুই ধরনের প্লাস্টিক দায়ী। মাইক্রোপ্লাস্টিক বা ক্ষুদ্র প্লাস্টিক, যা সাধারণত মেগা বা বৃহৎ হিসেবে পরিগণিত এবং ম্যাক্রো-প্লাস্টিক। প্লাস্টিক বর্জ্য প্রাথমিক বা মাধ্যমিক হিসেবেও শ্রেণিকরণ করা হয়ে থাকে। প্রাথমিক প্লাস্টিক সংগ্রহের সময় তাদের মূল গাঠনিক অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। উদাহরণস্বরূপ বোতলের ঢাকনা, সিগারেট বাট ও মাইক্রোবর্জ্য। যেসব প্লাস্টিক বর্জ্যরে আকার দুই থেকে পাঁচ মিলিমিটারের মধ্যে, ওই প্লাস্টিক বর্জ্যকে মাইক্রোবর্জ্য বলা হয়। মেসো ও ম্যাক্রো বর্জ্যকে ভাঙন ও পেষণের মাধ্যমে মাইক্রোবর্জ্যে পরিণত করা যায়। মাইক্রোবর্জ্য সাধারণত নারডল নামে পরিচিত। নারডল দ্বারা নতুন প্লাস্টিক পণ্য তৈরি করা হয়ে থাকে, কিন্তু ক্ষুদ্র আকারের কারণে এগুলো দ্রুত পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। ২০০৪ সালে যুক্তরাজ্যের প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড থম্পসন গবেষণার মাধ্যমে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলের সাগরের পানিতে প্রচুর পরিমাণে মাইক্রোবর্জ্য খুঁজে পান। থম্পসন ও তার সহযোগীরা ওই অঞ্চলের পানিতে গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ভাঙা অংশ খুঁজে পান, যার কিছু মানুষের চুলের থেকেও ক্ষুদ্র। ম্যাক্রোবর্জ্য প্রায়ই সমুদ্রের জলের মধ্যে পাওয়া যায়, যা সামুদ্রিক জীবের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপত্তির স্থান থেকে বিভিন্ন উপায়ে ভিন্ন ভিন্ন আকারে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। সমুদ্র স্রোত, বাতাসের অসম গতি ও ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের কারণে প্লাস্টিক বর্জ্য বিভিন্ন উপায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। যেহেতু প্লাস্টিক পচনশীল নয়, তাই সৃষ্টির পর পুনঃচক্রায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটি পরিবেশে অবস্থান করে। বিভিন্ন উপায়ে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের ভারসাম্যকে নষ্ট করছে। ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে, যা ভূগর্ভস্থ পানি ও ভূপৃষ্ঠীয় পানির সঙ্গে মিশে যায়। অতঃপর ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠীয় পানি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তা আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ে। কারণ এটির মাটিতে পচতে সময় লাগে ৪০০ বছর। আর এভাবেই পানি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। মাটিতে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব বাস করে, যা প্লাস্টিক অণুর ভাঙনে সাহায্য করে। এসব অণুজীবের মধ্য সিউডোমোনাস, নাইলন খাদক ব্যাকটেরিয়া ও ফ্লাভো ব্যাকটেরিয়া অন্যতম। এসব ব্যাকটেরিয়া ‘নাইলোনেজ’ এনজাইম ক্ষরণের মাধ্যমে নাইলন অণুকে ভেঙে ফেলে। প্লাস্টিক ভাঙনের মাধ্যমে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। মিথেন একপ্রকার গ্রিনহাউস গ্যাস। এটি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। ২০১২ সালে গবেষণার মাধ্যমে জানানো হয়, সমগ্র বিশ্বের সমুদ্রে আনুমানিক ১৬৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য আছে। নারডল নামক একপ্রকার শিল্পজাত প্লাস্টিক পণ্য বা কার্গো শিপ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। প্রচুর পরিমাণে নারডল সমুদ্রের পানিতে পতিত হয়। বছর বছর এই প্লাস্টিক পদার্থের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এর ফলে প্লাস্টিক থেকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর রাষায়নিক পদার্থ যেমন- বায়োস ফেনল, পলিস্টিরিন প্রভৃতি পরিস্রুত হয়। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, সমুদ্রের পানিতে পাঁচ ট্রিলিয়নের বেশি প্লাস্টিক ভেসে থাকে। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে যে পরিমাণ তারা আছে, সমুদ্রে প্লাস্টিক তার থেকেও বেশি। ১৪ মিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক প্রতিবছর সমুদ্রে জমা হচ্ছে। প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য একক সর্বাধিক হুমকির মতো। সামুদ্রিক কচ্ছপের মৃত্যু প্লাস্টিক দূষণের কারণে ঘটছে। সামুদ্রিক কচ্ছপ সাধারণত জেলিফিশ ও সামুদ্রিক কীট খেয়ে জীবনধারণ করে। জেলিফিসের আকার ও আকৃতি প্লাস্টিক ব্যাগের মতো হওয়ায় কচ্ছপ ভুল করে প্লাস্টিক ব্যাগ ভক্ষণ করে। এতে তাদের খাদ্যনালিকা বন্ধ হয়ে যায় এবং খাদ্য গ্রহণ করতে অক্ষম হওয়ায় ধীরে ধীরে মারা যায়।
প্লাস্টিক বর্জে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামুদ্রিক তিমি। মোটকথা প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক মৎস্য প্রজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব শুধু সামুদ্রিক মাছের ওপর নয়, সামুদ্রিক পাখির ওপরও রয়েছে। কারণ সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক ও মাছের মধ্য তুলনা না করতে পারায় পাখিরা প্লাস্টিক গ্রহণ করে। প্লাস্টিক পদার্থ থেকে সাধারণত বিষাক্ত রাসায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল নির্গত হয়। এই বিষাক্ত রাসায়নিক দেহের বিভিন্ন টিস্যুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পাখিরা যখন প্লাস্টিক পদার্থ গ্রহণ করে, তখন তাদের পেটেও বিষাক্ত রাসায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল নির্গত হয়। এর জন্য তাদের দেহের টিস্যু ধ্বংস হয়, তাদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ধীরে ধীরে পাখির মৃত্যু হয়। মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে প্লাস্টিক দূষণ। সাধারণত প্লাস্টিক পদার্থে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক রঞ্জক মেশানো হয়। এসব রঞ্জক কারসিনজেন হিসেবে কাজ করে ও এন্ডোক্রিনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্লাস্টিক দূষণ কমানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিছু কিছু সুপার মার্কেট প্লাস্টিক ব্যাগের মাধ্যমে আদান-প্রদান কমিয়েছে এবং বায়োডিগ্রেডেবল পদার্থ ব্যবহার করছে। বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিকের ব্যবহারের অনেক উপকারিতা ও অপকারিতা রয়েছে। বায়োডিগ্রেডেবলগুলো হচ্ছে একরকম বায়োপলিমার, যাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্পোস্টারের মধ্যে পচন ঘটে। ব্যবহৃত প্লাস্টিক মেডিকেল সামগ্রী এর মধ্যে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ল্যান্ডফিলের বদলে চুল্লিতে ভস্মীভূত করা হয়, যাতে রোগের ব্যাপ্তি কমে আসে। এর ফলে মেডিকেল সামগ্রী থেকে আসা প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ প্রচুর পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। যদি প্লাস্টিক বর্জ্যকে ভস্মীকরণের মাধ্যমে সঠিকভাবে মীমাংসা না করা হতো, তাহলে এখান থেকে যে ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ নির্গত হয়েছে, তা বাতাসে গ্যাস হিসেবে বা জল ও বাতাসে ছাই হিসেবে ছড়িয়ে যেতে পারত। সরকারিভাবে বিভিন্ন নীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে, যাতে নির্দিষ্ট কিছু প্লাস্টিক সামগ্রীতে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যকে ব্যবহার করা না হয়। বিভিন্ন দেশে বাচ্চাদের বোতল এবং কাপে বিপিএ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর কারণ স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা এবং শিশুদের ওপর বিপিএ’র অধিক ক্ষতিকর প্রভাব রোধ করা।
এস ডি সুব্রত : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ