প্রকাশ: শনিবার, ৩ জুন, ২০২৩, ৩:৩৮ PM
বাংলাসাহিত্যে এ যাবৎকালে যেসব দুর্দান্ত কিশোর চরিত্র যা পাঠকের কাছে সর্বদা স্মরণীয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি চরিত্র হলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘ছুটি’ গল্পের ‘ফটিক’ চরিত্রটি। ফটিক চরিত্রটি বৈশিষ্ট্য, কৈশোরের উদ্দামতা, আবেগ, ঘটনার পারিপাশির্^কতা, বয়সের চমৎকার বিশ্লেষণ এবং পরিণতিএসব মিলিয়ে ফটিক আজও সব কিশোরের কিশোরবেলার একটি প্রতিচ্ছবি। অনেকের কিশোরবেলার সাথেই আজ ফটিকের দুষ্টুমিভরা কিশোরবেলার মিল পাওয়া যায়। বৈজ্ঞানিকভাবেই এই বয়সটা উচ্ছল-প্রাণবন্ত, আবেগপ্রবণ, কুণ্ঠিতভাবের। কিশোরবেলা কেমন হওয়া উচিত, এই সময় কিশোরদের মানসিক অবস্থা কেমন হয় ইত্যাদি ফটিক চরিত্র থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয়। বিজ্ঞানীরাও এই বয়স নিয়ে সাবধানতা অবলম্বন এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে বলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠ করেননি এমন শিক্ষিত বা মোটামুটি লেখাপড়া জানা বাঙালি বইপড়তে পছন্দ করে এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এমনকি সারা বিশে^ই যারা সাহিত্য চর্চা করেন অথবা সাহিত্য জগতের সামান্যতম খোঁজখবরও রাখেন তিনি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়বেন। ব্যাপারটা এভাবে বলতে পারি, পৃথিবীর যে কোনো বাংলাভাষী এবং সাহিত্য অনুরাগীর সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় হয়েছে; না হয়ে উপায় নেই। এতো গল্প, এতো উপন্যাস আর এতো আশ্চর্য চরিত্র তিনি তৈরি করেছেন- সেইসব চরিত্র বা আখ্যান পাঠ না করে এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব, যে কোনো বাঙালির বা সাহিত্য অনুরাগীর পক্ষে। তার কবিতা, ছড়া, গল্প এবং উপন্যাস পড়তে পড়তে বড় হয়েছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমসাময়িক সময়ে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার লেখার সাবলীলতা, সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় অবাধ বিচরণ, সামাজিক সমস্যা আচরনের খুটিনাটি দিক তার লেখায় উঠে এসেছে। তার লেখায় এসেছে প্রেম ভালোবাসা, বিরহ দ্বন্দ, সমাজ, সংসার, পরিণতি। এসেছে সাধারণ মানুষের সুখ, দুঃখ হাসি কান্নার কথা। এসেছে অন্তর্দ্বন্দ্ব, দারিদ্র্যতা, অবহেলা সব। সেই স্কুল জীবনে যখন ছুটি গল্পটি পাঠ্য বইয়ে পড়তাম তখন থেকে তার লেখার প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা অনুভব করতাম। যদিও এই দুর্বলতা ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাঠে তার হাঁটু জল থাকে’ কবিতা পড়েছি তখন থেকেই রবীন্দ্র দুর্বলতা অনুভব করেছি। ‘ছুটি’ গল্পটি ১২৯৯ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে রচিত হয়েছে। এটি ১৮৯২ সালে ‘সাধনা’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। এবার আসি ফটিক চরিত্রটির কথায়।
দুরন্ত, বন্ধুবাৎসল্য, পরোপকারিতা আরও কত গুণ যে বৈশিষ্ট্য আয়োজন করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আমার মনে হয়, পৃথিবীর অনেক কিশোর চরিত্রের ভেতর ফটিক অসাধারণ, অনবদ্য এবং চমৎকার একটি চরিত্র। ‘ছুটি’ গল্পটি শুরুই হয়েছে ফটিকের খেলার দৃশ্য দিয়ে। শুরুটা এরকম- ‘বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট করিয়া একটা নূতন ভাবোদয় হইল, নদীর ধারে একটা প্রকান্ড শালকাষ্ঠ মাস্তলে রূপান্তরিত হইবার প্রতীক্ষায় পড়িয়া ছিল; স্থির হইল, সেটা সকলে মিলিয়া গড়াইয়া লইয়া যাইবে।’ এই হলো গল্পের শুরু। শুরু থেকেই বোঝা যায় ফটিক ছিল তার দুষ্টু বালকদলের মাথা এবং সর্বপ্রকার বুদ্ধি তার মাথা থেকেই উদয় হতো। সে তার লক্ষ্যে সবসময় স্থির থাকতো। তাই যখন সেই গুড়ির উপরে তার ছোট ভাই মাখনলাল এসে বসে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে যাচ্ছিল তখন সে প্রথমে মাখনলালকে সাবধান করলো এবং তারপরেও কাজ না হওয়াতে ভাই সহ মাস্তুল গড়ালো। এর ফলে মাখনলাল উল্টে গেলো এবং বাড়িতে তার বিরুদ্ধে মিথ্যে নালিশ করলো। এর জন্য তাকে মা’র হাতে চড় খেতে হয়। গল্পের এখানেই এক অপরিচিত মানুষের সাথে ফটিকের সাক্ষাৎ হলো যে আসলে ফটিকের মামা ছিল তাকে তাদের বাড়ির ভুল পথ বলে দেয়। এই অপরিচিত মানুষটির নাম ছিল বিশ^ম্ভরবাবু। ফটিকের শেষটা রচিত হয় এই মামার বাড়িতেই। ফটিক ছিল লেখাপড়ায় অমনোযোগী এবং চঞ্চল প্রকৃতির। তবে তার মা এবং ভাই মাখনলালের প্রতি মমত্ববোধের কমতি ছিল না। যদিও তার লেখাপড়ার প্রতি উদাসীনতা থাকায় এসব গুণ কারও চোখে পরেনি। এর কারণ সম্ভবত তার লেখাপড়ার প্রতি উদাসীনতা। তাকে লেখাপড়ার জন্য এবং মূলত তার এই চঞ্চলতা আটকাতে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। একটি গ্রাম্য পরিবেশে বড় হওয়া, মাঠে-ঘাটে খেলে বেড়ানো স্বাধীন মুক্ত পরিবেশের এক কিশোরকে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের বন্দী জীবনে। যেখানে সে মাত্র কয়েকদিনেই হাঁপিয়ে উঠেছিল এবং মুক্তির উপায় খুঁজছিল।
এক্ষেত্রে ফটিক চরিত্রটির জন্য খারাপ লাগলেও মূলত তার অভিভাবকের পক্ষ থেকে কোনো অস্বাভাবিক সিদ্ধান্ত ছিল না। কারণ প্রত্যেক মা তার সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করে। ফটিকের মা সেটিই করেছিল। তবে সব ভালো চাওয়ার পরিণতি যে ভালো হয় না ‘ছুটি’ গল্পে সেটিও প্রমাণিত হয়েছে। ফটিক প্রথমে যত আগ্রহ নিয়ে কলকাতায় অর্থাৎ শহরে এসেছিল ধীরে ধীরে তার সেই আগ্রহ কমতে থাকে। ফটিককে নিয়ে তার মামা নিজ বাড়িতে গেলে তার মামি স্বামীর এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হন। এখানেই গল্পের একটি চরম বাস্তবতা রয়েছে। ফটিকের বয়স যে আসলে মানিয়ে নেওয়ার জন্য একটি চরম পরীক্ষা সে কথা বলা হয়েছে এভাবে, তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নেই। শোভাও নোই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্ভতা। হঠাৎ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বাড়িয়া উঠে; লোকে সেটি তাহার একটা কুশ্রী স্পর্ধাস্বরূপ জ্ঞান করে। তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়, লোকে সেজন্য তাহাকে মনে মনে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না। শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ের কোনো স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও যেন অসহ্য বোধ হয়।’ কৈশোরের এই চরিত্র সম্পর্কে আরো কিছু বক্তব্য এখানে বর্ণিত রয়েছে। এমন চমৎকারভাবে এই বয়সের দুর্বল দিকগুলো আর কেউ কোনোদিন লিখেছেন বলে জানা নেই। অথচ সকলের জীবনেই এমন বয়স উপস্থিত হয়। নিজেকে বড় খাপছাড়া মনে হয়। একাকিত্বও বোধ করে। ফটিক যখন এই বয়সে একাকী একটি নতুন পরিবেশে আসে তখন তার সঙ্গে তার সবচেয়ে আপন মা ছিল না। মাতৃহীন বালকটি যেন আরও বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পরে। তারপর ছিল মাতৃসম মামীর দুর্ব্যবহার। সামান্যতেই তাকে কটু কথা শুনতে হতো মামীর কাছ থেকে। এমনকি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কাজ করলে তার মামী খুশি হওয়ার পরিবর্তে উল্টো ভৎর্সনা করতো। তখন তার মনে পরতো গ্রামে ফেলে আসা খেলার মাঠ, লাটাই, ঘুড়ি উড়ানো, নদীর তীর, গাছের গুঁড়ি এবং তার সমবয়সী খেলার বন্ধুরা। স্কুলে সে কোনোকালেই মনোযোগী ছাত্র ছিল না। কলকাতাতেও তাই। সে কেবল মামার কাছে মা’র কাছেই যেতে চাইতো। মামাও পূজার ছুটির আশ^াস দিয়ে রাখতো। কিন্তু কিশোর মন সেই ছুটির অপেক্ষায় আর কতই প্রতীক্ষা করে থাকতে পারে। তারপর আবার স্কুলে পড়াশোনায় ভালো না হওয়ার অপরাধে শিক্ষকের কাছে প্রায়ই অপমান-অপদস্থ হতে হতো। মামাতো ভাইদের সাথে তার সম্পর্ক মোটেও ভালো হলো না কেবল দুই পরিবেশের কারণে। শহরের ইট-কাঠ তাদের মনকেও নিজেদের মতো করেই তৈরি করেছিল সেখানে গ্রামের ফটিকের মতো চঞ্চল এবং সাধারণ স্বভাবের ছেলের সখ্যতা আশা করা যায় না। তারপর একদিন বই হারিয়ে বাড়িতে ফিরে আসায় মামীর কাছে কথা শুনতে হয়। শেষে যখন সে নিজ উদ্যোগেই গ্রামের দিকে বেরিয়ে যায় তখন রাস্তার দেখা না পেয়ে এবং বৃষ্টিতে ভিজে তার শরীর চূড়ান্ত রকম খারাপ হয়। প্রচন্ড জ্বরের ঘোরে সে প্রলাপ বকতে থাকে। ফটিকের মনে তখনও সেই গ্রামের খেলার কথাগুলো ঘোরপাক খাচ্ছে। অবশেষে তার মা যখন এসে উপস্থিত হন তখন ফটিক শেষ যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। তখন ফটিকের সেই মন খারাপ করে দেওয়া উক্তি- ‘মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’
আজকালের খবর/আরইউ