রবিবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
সময়ের অসাধারণ দলিল উত্তরাধিকার
এস ডি সুব্রত
প্রকাশ: শনিবার, ৩ জুন, ২০২৩, ৩:৩১ PM আপডেট: ০৩.০৬.২০২৩ ৩:৩৭ PM
দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয় কথাশিল্পী সমরেশ মজুমদার। অসংখ্য জনপ্রিয় উপন্যাস উপহার দিয়েছেন পাঠককে। এর মধ্যে উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, গর্ভধারিণী, সাতকাহন উল্লেখযোগ্য। উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ এই তিনটি বই হলো ধারাবাহিক সিরিজ বই। কেউ কেউ এই বই তিনটিকে ট্রিলজি হিসেবেও আখ্যা দিয়ে থাকেন। এই ট্রিলজির জন্য অসংখ্য পাঠক হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন সমরেশ মজুমদার নিঃসন্দেহে।

সমরেশ মজুমদার  নিপুণ দক্ষতায় অনেকগুলো জায়গা জুড়ে, বিস্তৃত এক সময়ের গল্প বলে গেছেন। লেখাটা একটু অন্যধারার। কুমারের হাতে যেমন নরম একতাল কাদা জীবন্ত মূর্তি হয়ে ওঠে, তেমনি দ্বিমুখী রাজনীতির আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে বালক অনিমেষের কৈশোর পেরিয়ে যুবক হয়ে ওঠার গল্প উত্তরাধিকার। সমরেশ মজুমদারের  অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস উত্তরাধিকার।  উপন্যাসটি প্রথম কলকাতার দেশ পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল  যা পরবর্তীতে বই আকারে বের হয়। বইয়ের মূল চরিত্র অনিমেষ মিত্র। অনিমেষের  শৈশব থেকে তারুণ্য পর্যন্ত যে জার্নি সেটিই বিশদভাবে এই বইয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। তার রাজনৈতিক দর্শনের সূচনাটা এই খণ্ডেই অংকন করা  হয়েছে। মূল চরিত্র ছাড়াও এ বইয়ে আরো অনেকগুলো চরিত্র এসেছে।  মাধুরী, সরিৎশেখর, হেমলতা, নিশিথ বাবু, মহিতোষ, সীতা, বাপি, মন্টু, সুনীলদা, জয়াদি, তপন, রম্ভা, প্রিয়তোষ, নবীন বাবু। চরিত্রগুলোর স্থায়িত্ব স্বল্প সময়ের জন্য হলেও প্রতিটি চরিত্র আমাদের অনুভূতিতে  নাড়া দিয়ে যায়।

উত্তরাধিকার  উপন্যাসের কাহিনী স্বর্গছেঁড়া চা বাগান থেকে শুরু, যেখানে অনিমেষ মিত্রের  শৈশব কেটেছে। স্বর্গছেঁড়া, জলপাইগুড়ি, কলকাতা আর দেশভাগের রাজনীতি এই বইয়ে সমরেশ মজুমদার নিপুণ দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। 

স্বর্গছেঁড়া বাগান থেকে শুরু- চারদিকে শীত শীত আমেজ, সবুজে ঘেরা, যেখানেই যায় অনিমেষ, ছায়ার মতো ঘেঁষে থাকে মায়ের আশীর্বাদ। মধ্যে জলপাইগুড়ি- শৈশবের সোনালি পর্দার ফাঁক গলে সেখানেই অনিমেষের বাস্তবতার প্রথম স্বাদ পাওয়া, গা শিউরে উঠা, এক কদম পিছিয়ে দুই কদম এগিয়ে যাওয়া। অবশেষে আছড়ে পড়া কলকাতায়Ñ উত্তাল রাজপথে যেখানে আগামী স্বপ্নের জাল বোনা। নিজের পরিবারের সঙ্গেই অনিমেষ বসবাস করছিল স্বর্গছেঁড়া চা বাগানের কোয়ার্টারে। স্বর্গছেঁড়া চা বাগানে ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি করতেন মিত্র পরিবার। মানে অনিমেষের দাদা এবং বাবা দুজনই বড় বাবু পদে চাকরি করতেন চা বাগানে। শান্ত নিরিবিলি চা বাগান, শীত শীত আমেজ, মাথার উপর ভুটানের পাহাড় থেকে ভেসে আসা বিষণ্ন মেঘের দলের জটলা পাকানো এবং মাঠ পেরিয়ে আসাম রোড। স্বর্গছেঁড়া চা বাগানের এই অপরূপ স্নিগ্ধ পরিবেশে জন্ম নেওয়া  অনিমেষের শৈশবটা বেশ ভালোই কাটছিল। চিরকাল যে মানুষগুলোর কাঁধে চরে অনিমেষ বড় হয়েছেন কালের পরিক্রমায় জীবনের বাঁকে বাঁকে তাদের সাথে নিজের বাঁধন আলগা হয়েছে। কোমল  হৃদয়ের অনিমেষের সবকিছুকে পেছনে রেখে হঠাৎ করেই জলপাইগুঁড়ি শহরে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করা, ফেলে আসা স্বর্গছেঁড়ার স্মৃতি, মাকে হারিয়ে  পিসিমার আগলে রাখা আঁচলের ছায়া, আর বুকের ভেতরের প্রগাঢ় ভালোবাসা প্রকাশ না করতে সদা তৎপর, দাদুর কঠোরতা ও দৃঢ়তার আদর্শের মাঝে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা তার জীবনের বুননকে একটু আলাদা করে ফেলে সবার থেকে। অনিমেষের কৈশোর পেরোনো, বিভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে শেখা, বিবেকবান হয়ে ওঠা, দেশকে ভালোবাসতে শেখা এই রকম আরো অনেক চিত্র নিয়েই উত্তরাধিকার লেখা হয়েছে। 

চিরকাল পরিবারের যে মানুষগুলোর কাঁধে চড়ে অনিমেষ বড় হয়েছে, কালের পরিক্রমায় জীবনের বাঁকে বাঁকে তাদের নিজেদের মধ্যকার বাঁধন আলগা হয়েছে, ক্লান্তি এসে ভর করেছে তাদের প্রত্যেকের উপর। বুকে আগলে তিলতিল করে মানুষ করেছেন যারা অনিমেষকে, সময়ের সাথে তাদের পরিবর্তন খুব চোখে পড়ার মতো। লেখক তার  উত্তরাধিকার  উপন্যাসে সে  সময়ের চিত্র এঁকেছেন  সে সময়টিতে ভারত সবেমাত্র ইংরেজদের শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে। সর্বত্র ভাঙাগড়ার খেলা। অনিমেষের  হাত দিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে তার মনে দেশপ্রেমের বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এ উপন্যাসে। যা পরের খণ্ডগুলোতে মহীরুহ আকার ধারণ করে। এরপর ধাপে ধাপে অনিমেষের বেড়ে ওঠা,  শৈশব থেকে কৈশোরে, কৈশোর থেকে তারুণ্যে। তরুণ অনিমেষ উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় গমন করে। যে দিন সে কলকাতায় যায় সেই দিন সারা শহরে আগুন জ্বলছে! আন্দোলনের এক ভয়ংকর পরিবেশ সর্বত্র। ঠিক এখানেই এই গল্পের সমাপ্তি। চুপচাপ ও নির্বিবাদী অনিমেষের চোখ দিয়েই ঔপন্যাসিক আমাদেরকে দেখিয়েছেন একটা অস্থির সময়ের নিখুঁত চিত্র। কংগ্রেস-বামদের বিরোধ, চিরাচরিত বাঙালি পরিবারের টানাপোড়ন ও ভালোবাসা, দেশপ্রেম আর সামনের অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়ানো সবটাই  উঠে এসেছে অবধারিতভাবে লেখকের অনন্য শিল্প গুণে, দাগ কেটেছে পাঠক হৃদয়ে ব্যাপকভাবে। উপন্যাসে  বিষাদ বেদনার পরিমাণ আনন্দের চেয়ে বেশিই বলা চলে নিঃসন্দেহে। প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তির পরিমাণই বেশি বিধৃত। বুকের ভেতর হাহাকার তোলা সব ঘটনার বিস্তার একের পর এক। লেখক যেন পাঠকের অনুভূতি নিয়ে খেলা করেছেন নিপুণভাবে অনুভবের আঙ্গিনাজুড়ে। এখানেই লেখকের স্বার্থকতা। 

বুকের ভেতর জেগে উঠা যে দেশপ্রেম সেটি প্রমাণের শ্রেষ্ঠ উপায় কি? রাজনীতিবিদের বুলির সাথে নীতিনির্ধারকের কাজে এত অমিল কেন? অনিমেষ নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেছে। যে দোলাচলের মধ্যে অনিমেষ নিজেকে আবিষ্কার করে সেটি অপরিচিত নয়, কারণ জীবনের কোনো একপর্যায়ে অধিকাংশ লোকই এই পথ মাড়িয়ে এসেছেন। লেখকের লেখায় উঠে আসা অনিমেষের মানবিক গুণাবলির চর্চা, নিজের একটি পরিচয় গড়ে তুলবার প্রচেষ্টা, পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পাওয়ার যে  লড়াই। তা যেন সত্যের খুব কাছাকাছি একবারে ।

উত্তরাধিকার শুধু একটি উপন্যাস নয়, এটি একটি  সময়ের দলিল। যে দলিল স্বাক্ষী হয়ে আছে অনিমেষ নামের একটি সাধারণ ছেলের চোখে দেখা একটা অসাধারণ সময়ের। 

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
সরকারের উন্নয়ন-অর্জন প্রতিটি ঘরে গিয়ে প্রচার করতে হবে
আওয়ামী লীগ ভিসা নীতি-নিষেধাজ্ঞার পরোয়া করে না: ওবায়দুল কাদের
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিতে গণমাধ্যমও যুক্ত হবে: পিটার হাস
ফুলগাজীতে ইয়াবাসহ দুই কারবারি গ্রেপ্তার
কাউখালীতে শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিলেন ইউএনও
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ফেনী ইউনিভার্সিটির প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত
বিএনপির আল্টিমেটাম: খালেদা জিয়াকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি দিতে হবে
গাজীপুর প্রেসক্লাবের নবনির্বাচিত কমিটির শপথ
চবি ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তি ঘোষণা
‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের ওপর মার্কিন ভিসা নীতি প্রয়োগ করা হয়েছে’
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft