রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ইফতারসামগ্রী বিতরণ
আবুল কালাম আজাদ
প্রকাশ: শনিবার, ৩ জুন, ২০২৩, ৩:২৭ PM
বাসটা মেইন রোড থেকে স্টেশনে ঢুকে দ্রুতবেগে বৃত্তাকারে একটা ঘূর্ণি দিল। তারপর টিকিট কাউন্টার থেকে কয়েক হাত দূরে ঘ্যাঁত করে থেমে গেল। 
যাত্রীরা সব নেমে গেলে মিনহাজ বাসের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ঠেলাঠেলি করে সে বাসে উঠতেও পারে না, নামতেও পারে না। 
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মিনহাজ সামনে, ডানে, বাঁয়ে তাকাল। বড় করে প্রশ্বাস টেনে নিল। বুকের হাফর ফুলে উঠল। তারপর আস্তে বাঁ পা-টা নামিয়ে দিল। অমনি পায়ের নিচে পচ করে একটা শব্দ। জুতা দেবে গেছে কাদায়। কয়েকদিন ধরে  মোটামুটি বৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামের কাঁচা মাটির স্টেশনে কাদা থাকবে এটিই স্বাভাবিক। 
মিনহাজের মুখে বিরক্তি বা খারাপ লাগার কোনো ভাব ফুট উঠল না। বরং মুখে প্রশান্তির ছাপ। প্রিয় পল্লীভূমির ধুলো-মাটি-জল-কাদা তার অতি প্রিয়। এসব গায়ে মেখেই তো সে এতবড় হয়েছে। রাজধানী শহরের পিচঢালা পথ তাকে টানতে পারেনি এতটুকু।
মিনহাজ গিয়ে বসল চায়ের দোকানে। চোখে-মুখে ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দিয়ে এককাপ চা খেলে ভ্রমণের ক্লান্তি দূর হবে। যাতায়াতের পথে এই নির্দিষ্ট দোকানটায়ই সে বসে। 
চায়ের দোকানদার তাড়াতাড়ি মগ ভরে পানি এগিয়ে দিল মিনহাজের হাতে। মিনহাজ চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিল। পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে মুখ মুছল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল, কেমন আছেন বারেক ভাই?
এই সমাচার জিজ্ঞাসার ছোট প্রশ্নটা চায়ের দোকানদার বারেকের চোখে জল এনে দেয় প্রায়। এলাকার কত মানুষই তো রাজধানী শহর বা অন্য কোনো শহরে থাকে। কেউ তার সমাচার জানতে চায় না। আর এলাকায় মিনজারে বয়সী যেসব যুবক আছে তাদের বেশিরভাগই ধমক দিয়ে কথা বলে। তুই-তোকারি করে কথা বলে। 
বারেক বলে, এই তো আছি একরকম। তা একেবারে ঈদ কইরা যাইবেন? 
বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ বন্ধ। ঈদের পরে যাব। 
এইবার একটু বেশি সময় থাকতে পারবেন তায়লে। 
হু।
শহরে কেমন লাগে?
ভালো লাগে না। গ্রামের কথা, গ্রামের মানুষের কথা মনে পড়ে খুব।
আপনে একটু অন্যরকম মানুষ। কতজন দ্যাশ ছাইড়া চইলা যায়...।
কথা বলতে বলতে মিনহাজের চোখ আটকে যায় সামনের দেয়ালে সেঁটে থাকা একটা পোস্টারে। পরে দেখল চারদিকেই এই পোস্টার লাগানো। বারেকের দোকানের গায়েও। 
চার রঙা বড় পোস্টারে লেখা আছে- ‘ইফতার সামগ্রী বিতরণ। স্থান-মোহনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ। আয়োজনে-কিসমত হাওলাদার।’ 
এরই মাঝে মাইকে ঘোষণাও শুনল। 
মিনহাজ নিজের অজান্তেই হেসে ফেলল। বারেক বলল, হাসলেন যে?
ধর্মীয় দান-খয়রাতেও নতুনত্ব আনা হয়েছে দেখছি। এতদিন তো শুধু জাকাত-ফিতরা দেওয়ার কথা শুনেছি। এখন দেখছি ইফতার সামগ্রী...। এরপর সেহরি সামগ্রীও দিবে তাহলে। 
হাওলাদার সামনে নির্বাচন করবেন। তিনি গ্রামে আসলেই পুরো এলাকায় জানান দেন। গত বছর জাকাত দেয়ার সময় যা ঘটল...।
গত বছর কিসমত হাওলাদার জাকাত দেয়ার সময় ১/২ জন লোক মারা গিয়েছিল। বেশ কয়েকজন আহত হয়েছিল। মিনহাজ তখন গ্রামে ছিল না। লোকমুখে শুনেছে। পত্রিকার খবরে দেখেছে। দান-খয়রাতের নামে গরিব মানুষকে এমন নির্মমভাবে মেরে ফেলা। এ জন্য বিচার হওয়া উচিত ছিল। সাজা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি। বরং হয়েছে মহৎ। এবার আরো ঘটা করে ইফতারসামগ্রী বিতরণের আয়োজন করছে। তার মাহত্য আরো বৃদ্ধি পাবে। একদিন সে হয়তো হবে দেশের আইন প্রণেতা। অথচ সে একজন হন্তারক।  
বারেক বলল, মন্ত্রী-মিনিস্টার হওয়ার প্রধান একটা উপায় হল, ধর্মীয় দান-খয়রাত, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন। কিছুদিন আগে আয়োজন করেছিলেন সাত দিনব্যাপী ওয়াজ মাহফিলের। চারদিকে দুই মাইল পর্যন্ত মাইক লাগাইছিলেন। ধর্মের কথা শুনলে জনগণ সব দোষ ক্ষমা করে দেয়। 
হাওলাদার সাহেব তাহলে খুব বেশি এলাকায় আসতেছেন। 
নির্বাচন করবেন যে। এখন আসবেন। নির্বাচন শ্যাষ, ফুড়ুৎ...! 
বারেকের কথা মিনহাজের ভালো লাগে। লোকটা সামান্য লেখাপড়া জানে। কিন্তু চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিবেচনা অনেক শিক্ষিত লোকের চেয়েও ভালো। অন্ধের মতো সবকিছু মেনে নেয় না। গভীরে গিয়ে ভাবতে পারে। 
মিনহাজ বলল, ইফতারসামগ্রী বিতরণ তো আজই। 
হ, আজ বিকালে। 
আপনি কি যাবেন ইফতার সামগ্রী আনতে?
না।
কেন?
আমার ছোট একটা চায়ের দোকান আছে। গায়ে খাটা ব্যবসা। মোটামুটি চলে। দান-খয়রাতের প্রতি লোভ নাই। 
খুব সুন্দর কথা বলেছেন। ছেলেমেয়েদের কি লেখাপড়া শেখাচ্ছেন?
জি। 
মাদরাসায়?
না, স্কুলে। এই যে আপনে, আপনের দিকে তাকায়া আমি আলোর ঝিলিক দেখতে পারতেছি। আমার ছেলেমেয়ের ভেতরও এমন আলোর ঝিলিক আসুক এটিই আমার চাওয়া। 
আপনার মতো করে যদি সব মানুষ ভাবতে পারতো তো আলোয় আলোয় ঝলমল করে উঠত আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশ। 
আমি আমার পোলা-মাইয়ারে এমনভাবে মানুষ করতে চাই যাতে ওরা কারও দয়ার ওপর নির্ভর না করে সম্মানের সাথে বাঁচতে পারে। যাতে দ্যাশ আর দ্যাশের মানুষের জন্য কাজ করতে পারে। 
সুন্দর চিন্তা।
এই যে মাদরাসার ছোট ছোট বাচ্চাগুলারে ঘরে ঘরে জাকাত-ফিতরার ট্যাকা তুলতে পাঠায়, কোরবানির চামড়া বেচার ট্যাকা তুলতে পাঠায়, এইসব আমার খুব খারাপ লাগে। বাচ্চাগুলারে এইভাবে ভিক্ষা শেখানো ঠিক না। 
বারেক ভাই, আমি তাহলে এখন উঠি। খুব ক্লান্ত। 
আইচ্ছা আসেন। যে কয়দিন গ্রামে আছেন আইসেন আমার দোকানে। আপনের সাথে যেমুন মন খুইলা কথা কইতে পারি, সবার সাথে তেমুন পারি না।
রিকশায় উঠে কিছুদূর এগিয়েই মিনহাজ শুনল, পথের মোড়ে মোড়ে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে, ইফতারসামগ্রী বিতরণের কথা। 
মিনহাজ বলল, বেশ ঘটা করেই বিতরণ হচ্ছে দেখছি। 
কথাটা রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যেই বলা। কারণ, কাছে-পিঠে আর তো কেউ নেই। রিকশাওয়ালা বলল, জে। আপনেরে নামায়া দিয়া আমিও যামু। বউ-পোলাপান পাঠায়া দিছি আগেই। 
কতদিনের ইফতার সামগ্রী দিবে?
যা দেয়...। যা পাই তাতেই লাভ। সবসুম তো আর ভালো খাইতে পারি না। 
মিনহাজ দেখল, চা দোকানদার বারেকের চিন্তা-ভাবনা আর এই রকশাওয়ালার চিন্তা-ভাবনা বিপরীত। রিকশাওয়ালার গতানুগতিকের মধ্যেই বাস। অবশ্য এসব মনাুষের পক্ষে গতানুগতিক চিন্তা থেকে বের হয়ে আসা খুব কঠিন।
মিনহাজ বলল, ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখতে দিয়েছেন?
মাদ্রাসায় দিছি। জজ-ব্যারিস্টার তো বানাইতে পারুম না। এই দুনিয়ার জীবন এমনিই যাইব। পোলাপানের জন্যি যদি পরকালে একটু...।
আপনি কি মনে করেন, যাদের ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে তারা ছেলেমেয়ের জন্য পরকালে কিছুই পাবে না? একজন মানবসেবী ভালো ডাক্তার, একজন জাতি গঠনের শিক্ষক তারা মাদ্রাসায় পড়েনি বলে তাদের জন্য পরকালে কোনো পুরস্কারের ব্যবস্থা নেই? এই যে আপনি, গায়ের ঘাম দিয়ে বেঁচে আছেন, আপনার জন্য কি পরকালে কোনো উপহার থাকবে না? পুরস্কারের জন্য হাত পাততে হবে আপনার মাদ্রাসায় পড়ুয়া সন্তানদের কাছে? 
রিকশাওয়ালা আর কিছু বলল না। নীরবে রিকশা চালাতে লাগল। হয়তো তার বলার কিছু ছিল না। নিশ্চয় সে এভাবে ভেবে দেখেনি কখনো।
মিনহাজ বলল, আর জজ-ব্যারিস্টার বনাতে পারবেন না এ ধারণাটাও ভুল। সরকার লেখাপড়াকে অনেকদূর পর্যন্ত ফ্রি করে দিয়েছে। ভালো রেজাল্টের জন্য আছে নানা রকম বৃত্তির সুবিধা। একটা পর্যায়ে যাওয়ার পর ছেলেমেয়েরা নিজের ভার নিজেই বহন করতে পারে। এই যে আমি-আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে থাকি। টিউশনি করি, পত্রিকায় পার্টটাইম কাজ করি। বাড়ি থেকে আমাকে কোনো টাকা পাঠাতে হয় না। বরং আমি বাবা-মা, ছোট বোনকে এটা-ওটা উপহার দেই। 
রিকশাওয়ালা কিছু বলল না। পেছন ফিরে বারবার মিনহাজের মুখ দেখতে লাগল। হয়ত তার ভেতর কোনো বোধ এসেছে। তার মুখে কিছুটা অপরাধ বোধের চিহ্ন। ভুল চিন্তা-ভাবনার জন্য অপরাধ বোধ।    

বাড়িতে এসে মিনহাজ মায়ের হাতের রান্না ছোট মাছের চচ্চড়ি গরম ভাত খেল। সাথে ডাল আর আমের আচার। মিনহাজ শহরে গিয়ে অনেক রকম খাবারই খেয়েছে। পাঁচ তারকা হোটেলে খাওয়ার অভিজ্ঞতাও হয়েছে তার। কিন্তু মায়ের হাতের এইসব চচ্চড়ি, ঝোল, ভাজি, ভর্তা এসবের তুলনা খুঁজে পায়নি কোথাও। 
খাওয়ার পর বাবা-মায়ের সাথে এটা-ওটা নিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করল। তারপর মিনহাজ ঘুমিয়ে পড়ল। স্বাভাবিকভাবে শরীরটা ক্লান্ত ছিল। দক্ষিণা জানালার কোলে মাথা রেখে তৃপ্তির ঘুম। 
মিনহাজের ঘুম ভাঙল বিকালের কিছু আগে। মা মুরগির ঝোল রেঁধেছে। চিতই পিঠা বানাচ্ছে। মা বলল, গরম গরম দুইটা পিঠা খা।
না মা, সবার সাথে ইফতারির সময় খাব।
ইফতারির সময় আবার খাইস। আইজ রোজা রাখোস নাই যখন তখন খা দুইটা। গরম গরম ভাল্লাগবে।
খাওয়ার মতো ক্ষুধা পেটে ছিল না। মাকে সন্তুষ্ট করতে খেতে হবে। তা ছাড়া মায়ের হাতের রান্না ভরা পেটেও ক্ষুধা ডেকে আনে। সে মুরগির মাংস দিয়ে দুটো চিতই পিঠা খেল। তারপর এক কাপ চা। ভ্রমণের কারণে আজ সে রোজা রাখেনি। আগামীকাল অবশ্য রোজা রাখবে। 
দিনের তাপ তখন কমতির দিকে। মিনহাজ হাঁটতে বের হল। সবুজ ফসলের ক্ষেতের বুক চিরে সবুজ-নরম ঘাসে ঢাকা আলপথ। আলপথ দিয়ে একা একা হেঁটে যাওয়া তার শৈশবের অভ্যাস। বাতাস আছে বলে যা একটু রোদ আছে তা গায়ে লাগে না। 
হাঁটতে হাঁটতে সামনে উঁচু রাস্তা। রাস্তার একটা দিক গেছে বাজারের দিকে, আরেকটা দিন মোহনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে। 
মিনহাজ রাস্তায় উঠে চমকে গেল। মোহনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে মানুষের স্রোত ছুটে যাচ্ছে। সবাই গরিব মানুষ। পুরুষ ও শিশুদের শরীরে জীর্ণ পোশাক, অথবা পোশাক নেই। নারীর শরীরে জীর্ণ কাপড়। সবাই এভাবে ছুটছে কেন? পরক্ষণেই মিনহাজের মনে পড়ল, মোহনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ইফতার সামগ্রী দেবে। 
রাস্তার এক পাশ ধরে হেঁটে মিনহাজ বাজারে গিয়ে পৌঁছুল।
বাজারে চায়ের দোকানে গিয়ে দেখা হল ইরফান আলীর সাথে। ইরফান আলী মিনহাজের বাল্যবন্ধু রশীদের বাবা। 
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই মিনহাজ আর রশীদ একসাথে পড়াশোনা করছে। দু’জনের বন্ধুত্বটাও খুব গভীর। এইচএসসি পাস করে মিনহাজ রাজধানী শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেল। আর রশীদ গ্রামের ডিগ্রি কলেজে বিএ পড়তে ভর্তি হল। ওদের আর্থিক সঙ্গতি তুলনামূলক কম। তারপরেও তার বাবা ইরফান আলী তাকে রাজধানী শহর বা অন্য কোনো শহরে বিশ্ববিদ্যালে পড়াতে চেয়েছিলেন। কিছু জমিজমা বিক্রি করতেও তার আপত্তি ছিল না। কিন্তু রশীদ রাজি হয়নি। রশীদের স্বপ্ন অন্যরকম। তার স্বপ্নকে ছোট করে দেখার অবকাশ নাই। রশীদের ইচ্ছা বিএ পাস করে সে তথ্য প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ নিবে। থানা শহর, জেলা শহরে সেরকম সুযোগ যথেষ্ট আছে। বাড়ি থেকে থানা শহর বাসে করে আধা ঘন্টার পথ, আর জেলা শহর দেড়/দুই ঘণ্টার। সে এলাকার মানুষদের জন্য তথ্য-প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করবে। এতে এলাকার মানুষ অল্প খরচে তথ্য-প্রযক্তির শিক্ষা পাবে, তার নিজেরও কিছু রোজগার হবে। পাশাপাশি সে জেলা শহরের বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এমএটাও করে নিবে। সে চাকরির পেছনে ছুটতে চায় না। এরপর সে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি প্রয়োগ করে সবজি বাগান, মাছ ও হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তুলতে চায়। তার গ্রামে সে গড়ে তুলতে চায় একটা পাঠাগার। শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার জন্য গড়ে তুলতে চায় সংগীত-নৃত্য ও ছবি আঁকার স্কুল। এলাকার কিশোর-যুবকরা সেলফোন নিয়ে সময় অপচয় করে, এই বিষয়টা তাকে খুব পীড়া দেয়। বলা যায়, রশীদ যদি তার স্বপ্নগুলো সুন্দর ও সুচারুরূপে বাস্তবায়ন করতে পারে তো সে নিজে শুধু সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষ হবে না, পাশাপাশি দেশের জন্য করতে পারবে অনেক কিছু। 
ইরফান আলী বললেন, তুমি কবে আসছো বাবা?
চাচা, আজই আসছি। আপনারা সবাই ভালো আছেন তো?
আছি একরকম। তা রশীদ কি জানে যে তুমি আসছো? 
জি, আমি ওকে ফোন করে দিয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যে বাজারে আসবে।  
তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে?
জি চাচা, চলছে ভালই। 
ছাত্র রাজনীতির সাথে আবার জড়িত হইও না।
চাচা, বর্তমান ছাত্র রাজনীতি আর রাজনীতি নাই। দেশের জন্য, মানুষের জন্য ওরা রাজনীতি করে না। করে নিজের জন্য। বর্তমানের ছাত্র রাজনীতিকে আমার কাছে মাস্তানি মনে হয়। যে যত বড় ছাত্র নেতা, সে তত বড় মাস্তান। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ওরাই করে। ছাত্র অবস্থায়ই ওদের দামি গাড়ি, দামি বাড়ি, বিশাল ব্যাংক ব্যালেন্স, বড় ব্যবসা এসব হয় কেমন করে?
এখন আবার শুনছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাও জঙ্গিপনায় জড়িত হচ্ছে। 
কিছু কিছু তো হচ্ছেই। 
খুবই দুঃখের কথা! বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত ছেলেপেলে হবে সূর্যের মতো উজ্জ্বল। তারা হবে উদার, মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ। তাদের চারপাশে থাকবে আলোর ঝলকানি। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সংগীত, চিত্রকলা, নৃত্য, অভিনয়, খেলাধুলা এসব দিককে তো তারাই এগিয়ে নিয়ে যাবে ধাপে ধাপে। কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা যদি জঙ্গিপনার মতো অন্ধকার জগতে তলিয়ে যায়, তাহলে দেশের আর থাকে কী? মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত একটা দেশের এরকম অবস্থা হবে তা ভাবতেও ব্যথায় বুক টনটন করে ওঠে। 
এমন সময় সাইকেল চালিয়ে রশীদ এল। রশীদ আসতেই ইরফান আলী বললেন, তোমরা গল্প করো, আমি তাহলে যাই। আর শোনো বাবা, কাল দুপুরে আসবে। আমার সাথে দু’টো ডালভাত খাবে। 
আসবো না আবার! চাচীর হাতের রান্না খাওযার জন্য আমি উদগ্রীব।  
হাহাহা। আজ রাতে পুকুরের মাছ ধরে রাখবো।
ছোটমাছগুলো পেঁয়াজ দিয়ে চচ্চড়ি। জিভে পানি এসে গেছে এই দেখেন টসটস করে পানি পড়তেছে।
হাহাহা। 
দোকানে উপস্থিত আর সবাইও হেসে উঠল। চায়ের দোকানদার বলল, বড় ভালো মানুষ এই ইরফান আলী ভাই। এমুন মানুষ এই জমানায় কম হয়।
মিনহাজ আর রশীদ চায়ের কাপ হাতে নিল। চায়ে দু-একটা চুমুক দিয়েই কান খাড়া করল। বাজারে অন্য সবাইও সজাগ হল। কেমন একটা হট্টগোলের শব্দ। তারপর শুনল আর্তনাদ। সচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখে মোহনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিক থেকে পাগলের মতো লোকজন ছুটে আসছে। 
কী ঘটছে কেউ অনুমান করতে পারছিল না। একটু পর লোকজন কাছে এলে ঘটনা জানল। ইফতার সামগ্রী দেবার সময় কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ছিল না কেউ। মানুষ ছিল হাজার হাজার। প্রথমে ধাকাধাক্কি। তারপর হুড়োহুড়ি। নারী আর শিশুরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পায়ে পৃষ্ট হতে থাকে। কতজন নারী ও শিশু যে মারা গেছে এবং আহত হয়েছে তার হিসাব নেই। 
বাজারে কয়েকটা ভ্যানগাড়ি দাঁড় করা ছিল। রশীদ বলল, মিনহাজ চল, যা পারি করি। 
মিনহাজ, রশীদ এবং আরও কয়েকজন ভ্যানগাড়ি নিয়ে ছুটল। অন্যরা দৌড়াতে লাগল। 
মোহনপুর প্রথমিক বিদ্যালয়ের কাছাকাছি যেতেই দেখা হল সেই রিকশাওয়ালার সাথে, যার রিকশায় মিনহাজ স্টেশন থেকে বাড়িতে এসেছিল। সে কপাল চাপড়ে বলছে, আমার বউ নাই। পোলা-মাইয়া পামু কিনা জানি না। 
আহতদের ভ্যানগাড়িতে তুলে ওরা থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পাঠাতে লাগল। আরো কিছু রিকশা ভ্যান ইত্যাদির জোগাড় হলো। ওদের দেখে আরো যুবক ওদের সাথে যুক্ত হলো। কিন্তু পরিস্থিতি অনেক খারাপ। 
অবশেষে এল পুলিশ ও ফায়ার ব্রিগডের লোকজন। মিনহাজরা প্রথমেই তাদের ফোন করে দিয়েছিল। 
সারি সারি লাশ। ১৫-২০টা তো হবেই। হাসপাতালে লাশের মিছিল আর বাড়বে। 
ইফতারসামগ্রী বিতরণের সেই রুই-কাতলারা লাপাত্তা। পুলিশ তাদের টিকির নাগাল পেল না, পাবে না, পায়ও না।

ঈদের ছুটি শেষ হলে ঢাকায় ফেরার পথে মিনহাজ আবার বারেকের চায়ের দোকানে। গাড়ির টিকিট কেটে আসন ঠিক করেছে। গাড়ি ছাড়তে দেরি আছে। এই অবসরে এক কাপ চা খেয়ে নেওয়া যায়। 
আগের মতো গল্প উঠে আসছিল না। বিমর্ষতার ছায়া চোখে-মুখে। মিনহাজের, বারেকেরও। 
ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বারেক বলল, চইলা যাইতেছেন?
হু। আনন্দ নিয়ে গ্রামে এসেছিলাম। সব আনন্দ রূপ নিল দুঃখ-বিষাদে। চোখ বন্ধ করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সারি সারি মৃতদেহ, আহত মানুষ। কানে ভেসে আসে আর্তনাদ। এইভাবে মানুষ মারে!
বারেক চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, মানুষ য্যান কুত্তা-বিলাই। খাওন ছুইড়া দিলাম, কাড়াকাড়ি কইরা খাইল। 
মিনহাজ কিছু বলল না। নীরবে চা খেতে লাগল। 
একটু পর বারেক বলল, তার তো লোকজনের অভাব নাই। প্রতিদিন একেক গ্রামে একশ পরিবাররে ইফতারির জিনিস দিলে দশ দিনে দশ গ্রামের এক হাজার পরিবাররে দেয়া যায়। কিন্তু তাতে যে মানুষ জানবো না। তাই ঢোলা পিটায়া, মাইক বাজায়া...। 
মিনহাজ কিছু বলল না। বারেকের কথা সুন্দর। যুক্তিসম্পন্ন শুদ্ধ চিন্তার মানুষ সে। খুব সুন্দর করে ভাবতে পারে। 
একটু পর বারেক বলল, সত্যি কইলে কমু, এই দান-খয়রাত বিষয়টাই আমার পছন্দ না। মানুষের জন্য যদি কিছু করতে হয় তো এমনভাবে করা দরকার যাতে কেউ সারা জীবন কিছু কইরা খাইতে পারে। এক-দুই দিনের খাওন দিয়া কী হয়? 
মিনহাজ চায়ের দাম দিয়ে নীরবে হেঁটে গেল। যেতে যেতে ভাবল, বারেক ভাই, আপনার মতো করে যদি এ দেশের প্রতিটা মানুষ ভাবতে পারত! 

আজকালের খবর/আরইউ