
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৪ বছরে মোট ১৫টি বাজেট দেওয়া হয়েছে। সব বাজেটই জনকল্যাণ ও গরিববান্ধব। এ ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জন্য সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার যে বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে, সেটিও গরিববান্ধব বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, পুরো বাজেটই গরিব মানুষের জন্য উপহার। বর্তমান সরকার এক কোটি পরিবারকে টিসিবির মাধ্যমে সুলভমূল্যে চাল-ডাল-চিনি-তেল দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ উপকারভোগী হচ্ছেন। প্রস্তাবিত বাজেটে এর আওতা ও বিধাব-বয়স্কসহ বিভিন্ন ধরনের ভাতা বাড়ানো হয়েছে।
আজ শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের (বিআইসিসি) অডিটরিয়ামে অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. শামসুল আলম, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার, অর্থ সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন ও ইআরডি সচিব শরিফা খানসহ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা। সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমরা ফেইল করি নাই। ইনশাআল্লাহ এবারও ফেইল করব না, আগামীতেও আমরা ফেইল করব না। এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।”
মানুষের কর্মদক্ষতা ও দায়বদ্ধতার উপর ভর করেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান জানিয়ে মুস্তফা কামাল বলেন, “সবকিছুর মূলে হচ্ছে এ দেশের মানুষ, জনগোষ্ঠী- তাদের কর্মদক্ষতা, দেশের প্রতি তাদের মায়ামমতা, মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা, এটা অসাধারণ এক উদাহরণ আমি মনে করি। “এবং সেজন্য আমার বড় বিশ্বাস, আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের পরাজয় নেই। ইনশাল্লাহ আমরা বিজয়ী হবই হব।”
কর্মসংস্থান বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এ পর্যন্ত যেসব কমিটমেন্ট আমি দিয়েছি, সবগুলো পূরণ করেছি। আমি বলেছি দুই কোটি মানুষের চাকরির ব্যবস্থা করবো, কিন্তু আমরা দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষের চাকরির ব্যবস্থা করেছি। দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে, চাকরিপ্রার্থীও বেড়েছে। তবে এখন কর্মসংস্থানও বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা যখন দেশ পরিচালনা শুরু করি, তখন ৫৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতাম, সেটি দুই লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করতে পেরেছি। সুতরাং এবারো আমরা বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারবো। তিনি বলেন, দেশে অনেক মধ্য আয়ের মানুষ আছে, সময় এসেছে তাদের ট্যাক্স পেমেন্ট করতে হবে। যারা আয় করেন ট্যাক্স দেওয়ার সক্ষমতা আছে তাদের ট্যাক্স দিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরা নিজেরাও শঙ্কিত। সারাবিশ্বই এখন মূল্যস্ফীতিতে আছে। আমরা খাবার তো বন্ধ করতে পারবো না। মানুষকে খাবার না দিয়ে রাখা যাবে না। আমরা একটা ফ্লেক্সিবল ওয়েতে এগোচ্ছি। যেসব কারণে এটি হয়, সেটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা ছাড় দিচ্ছি। তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে প্রচুর খাদ্য সরবরাহ করছি। পাশাপাশি যেসব পণ্য নিত্যপ্রয়োজনীয়, সেখানে নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারকে সাহায্য করছি। এভাবে আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করছি। মুস্তফা কামাল বলেন, যখন আমরা ক্ষমতায় আসি, তখন মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশ। পরের ১০ বছরে সেটি ছয় শতাংশে নেমে আসে। সারাবিশ্বে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। এখন খুব খারাপ সময়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা ভালো আছি। এবারো যেসব প্রজেকশন আমাদের আছে, সবই আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো বলে আশা করি।
বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে গত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলেও এবারের বাজেটে এ ধরনের কোনো সুযোগ কেন রাখা হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, গত বছরের বাজেটে বলেছিলাম, কেউ যদি অপ্রত্যাশিত টাকা দেশে নিয়ে আসে, তাহলে সেই টাকার কোনো কর দিতে হবে না। গত বাজেটে এ সুযোগটি দেওয়ার পরও এখন পর্যন্ত কোনো অপ্রত্যাশিত টাকা বাংলাদেশে আসেনি। তাই এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়নি। গত অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, কেউ যদি বিদেশ থেকে অর্থ আনেন, তাহলে সাত শতাংশ কর দিলেই হবে। আর বিদেশে থাকা স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে ওই সম্পদের মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ এবং বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে এর ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। গত বছরের ১ জুলাই থেকে চলতি মাসের ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ এক বছরের জন্য এ সুবিধা বহাল থাকবে বলে জানানো হয়েছিল।
আইএমএফ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) শুধু লোন দেয় না, তারা সার্বিক পরামর্শ দেয়। তাদের পরামর্শ নিলে সফল হবেন বলে মনে করে তিনি বলেন, আইএমএফের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের সবার সার্বিক বিষয়ে তারা দেখে। তারা শুধু লোন দিয়েই সাহায্য করে না, কিছু প্রজেক্টও সাজেস্ট করে। কোন কোন বিষয় বাস্তবায়ন করা যাবে সেগুলোও তারা পরামর্শ দেয়। আমি মনে করি, তাদের পরামর্শ শুনলে সফল হবো। বাজেটে আইএমএফের প্রভাব প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা সবাই এখন অ্যালায়েন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আমরা কোনো পণ্য না পেলে খুঁজি বিকল্প কোন দেশে সেটি পাওয়া যাবে। সার্বিক বিষয়ে আইএমএফের ওভারঅল প্রেসক্রিপশন থাকে। তবে সেখান থেকে যেটুকু গ্রহণ করা যায় করবো। বাকিসব আমরা আমাদের মতো করবো।
ডলারের দাম ধরে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে দেশের ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট তৈরি হয়েছে। এতে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ ব্যয় বেড়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশে রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হবে জানিয়ে বলেন, প্রতি ডলারের দাম এখন ১০৮ টাকা ১০ পয়সা। পাশপাশি সুদহারের সীমা প্রত্যাহার ও ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার কাজ চলছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের চার দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে ১৮ দশমিক ছয় বিলিয়ন ডলার হয়েছে। পাশাপাশি, রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসন ও বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে আর্থিক হিসাবও নেতিবাচক অবস্থানে চলে এসেছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের জুনের ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে কমে ২০২২ সালের জুনে ৪১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন হয়। রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে আরো কমে বর্তমানে ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। একই সঙ্গে মার্কিন ডলারের তুলনায় টাকার মূল্যমান কমেছে। ২০২২ সালের জুনে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ছিল ডলারপ্রতি ৯৩ টাকা ৫০ পয়সা। গত ২৪ মে বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে প্রতি ডলার ১০৮ টাকা ১০ পয়সা। অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক চেষ্টায় বাজারে সাময়িক তারল্যসংকট তৈরি করে। এর প্রভাবে ব্যাংক উৎস হতে ঘাটতি অর্থায়নে সরকারের সুদ ব্যয় বৃদ্ধি পায়। অর্থমন্ত্রী বলেন, ২০২০ সালের এপ্রিলে আরোপ করা সুদহারের সীমা প্রত্যাহারের কাজ চলছে। একই সঙ্গে মার্কিন ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার কাজ চলছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) পাঠাতে উৎসাহ দিতে আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা প্রদান করা হচ্ছে। আগে এ প্রণোদনা দুই শতাংশ ছিল। তবে ২০২২ সালের প্রথম দিন থেকে তা বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করার ঘোষণা দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে প্রবাসী আয় খাতে প্রণোদনা বাবদ ৬২ বিলিয়ন টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তিনি বলেন, নতুন করে সহজে রেমিট্যান্স পাঠানোর উপযোগী মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসসহ (এমএফএস) অন্যান্য পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশি ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে সব ফি মওকুফ করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের প্রভাবে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, রপ্তানি আয় বাড়ানোর উপযোগী কার্যক্রম বাস্তবায়নের ধারা অব্যাহত রাখা হয়েছে। পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক অর্থায়ন ছাড়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। জ্বালানি-বিদ্যুৎ মর্যাদার জায়গায় এসেছে। আমরা ভালো ভালো শিল্প কারখানা গড়ে তুলছি। জ্বালানি-বিদ্যুৎ ঠিকমতোই সরবরাহ করা হচ্ছে। তাজুল ইসলাম বলেন, কোভিডের পর বিশ্ব সংকটে পড়ে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানিসহ সব জিনিসের দাম বৃদ্ধি পায়। জ্বালানির উপকরণ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। দেশের অর্থমনীতি বিবেচনা করে অনেক বেশি ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এরইমধ্যে ইউরোপে মূল্যস্ফীতি বেশি। এশিয়ায়ও প্রভাব পড়েছে। সরকার কৌশলী ভূমিকায় থেকে কাজ করছে। এ কারণেই মূলত জ্বালানি-বিদ্যুৎ ঠিকমতো সরবরাহ করা হচ্ছে। জিডিপির গ্রোথও ভালো। আইএমএফের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, আইএমএফের কাছে ঋণ চাইলে তারা ম্যাক্স ম্যানেজমেন্ট ইভাল্যুয়েশন করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যবস্থা ভালোভাবে চলছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে, আইএমএফ এটা বলেছে। দেশের অর্থনীতি ভালো, খাদ্য ঘাটতিও নেই। ১৪ বছরে দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা যায়নি। আমাদের আর্থিক ব্যবস্থা ভালো আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, পণ্যের দাম বাড়লেও অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা ভালো। তিনি বলেন, সারা পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখবেন, আমরা কোন অবস্থায় আছি। নিম্নআয়ের মানুষের কিছু কষ্ট হচ্ছে, এটা অর্থমন্ত্রীও বলেছেন। আমরা কিন্তু এটি মাথায় রেখে এক কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে ডাল-চিনি দিয়েছি। পেঁয়াজের দাম যখন বেড়েছে আমরা কমদামে পেঁয়াজ বিক্রি করেছি। টিপু মুনশি বলেন, আমরা আশা করছি সামনে আরো ভালো কিছু হবে। তবে অন্যদের তুলনায় দেখলে আমরা ভালো আছি। বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিয়ে সমস্যা তৈরি করে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা যেসব পণ্য ইম্পোর্ট করি তার দাম যদি বাড়ে বাজারেও এর প্রভাব পড়ে। কোথাও কোথাও সমস্যা আছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিয়ে সমস্যা তৈরি করে।
আজকালের খবর/ওআর