নতুন অর্থবছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দেশ। সেই সঙ্গে একটি নতুন বাজেট প্রণীত হতে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট এমন একটি সময়ে আসতে যাচ্ছে যেখানে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির একটি দুঃসময় চলছে। মন্দাভাব প্রকট না হলেও অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা রয়েছে। তা ছাড়া এই আগামী বাজেট হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবং বর্তমান সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেট।
একটি কার্যকরী বড় বাজেট জনগণের মনে আশার সঞ্চার করে। এজন্য শুধু বাজেট প্রণয়ন করলেই চলে না বাজেটের বাস্তবায়নের হারও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও নানা কারণে স্বাধীনতার পর থেকে ঘোষিত বাজেটের শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সে কারণে চেষ্টা করা উচিত যত বেশি সম্ভব বাজেট বাস্তবায়নের হার বৃদ্ধি করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন অনুযায়ী দেশের বাজেটের আকার প্রতি বছরই বড় হচ্ছে। একই সঙ্গে উন্নয়ন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মধ্যবিত্তের ওপর চাপ কমানো ইত্যাদি বিষয়গুলো বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত থাকে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আরেকটি বাজেট আসছে। এমন এক পরিস্থিতিতে এই বাজেট ঘোষিত হতে যাচ্ছে যখন সারা বিশ্বই এক ধরনের মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সামলাচ্ছে। বিশ^জুড়ে খাদ্য সংকটে মতো পরিস্থিতি চলছে। মূল্যস্ফীতির ধাক্কা আমাদের দেশেও আঘাত করেছে। বিশ্ব পরিস্থিতিও ভালো নয়। তবে বেকারত্ব এবং এর থেকে সৃষ্ট সমস্যাসমূহ বিদ্যমান। অর্থনৈতিক ক্ষতি, সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা এবং এরপরপরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে দ্রব্যমূল্যের বাজারে উত্তাপ এবং এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে বিশ^জুড়ে। এর সঙ্গে রয়েছে বেকারত্ব দূরিকরণের উদ্যোগ হিসেবে চাকরির বাজার সৃষ্টি, শিক্ষায় ক্ষতি পোষাণো, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা ইত্যাদি। তার সঙ্গে রয়েছে আইএমএফের শর্ত মেনে চলা, রিজার্ভ শক্তিশালী করা এবং ডলার সংকটে বিষয়গুলো। মানুষের জীবিকায় ফেলেছে মারাত্বক প্রভাব। শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য বারবার স্থবির হয়েছে। চাকরি হারিয়ে বেকার হয়েছে বহু মানুষ।
সুতরাং এবারের বাজেট গতবারের থেকেও চ্যালেঞ্জিং। করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ অর্থনীতি মেরামত করতে না করতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সেই চ্যালেঞ্জকে আরো কঠিন করে তুলেছে। প্রতিটি সেক্টরে ক্ষতির প্রভাব রয়েছে। অর্থনীতি চাঙ্গা করে মানুষের জীবন-মান উন্নয়নের সঙ্গে দেশের অর্থনীতি উন্নয়নের গতি ধরে রাখা এবং জীবনযাত্রার ওপর ব্যয়ের চাপ কমানো এই বাজেটের চ্যালেঞ্জ থাকে। জানা গেছে, এবারের (২০২৩-২৪) বাজেটের আকার হতে যাচ্ছে সাত লাখ ৬১ হাজার ৯৯১ কোটি কোটি টাকার। মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লাখ কোটি টাকা এবং ঘাটতি দুই লাখ ৬১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এটিই এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় বাজেট। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ থাকবে দুই দশমিক ৬৩ লাখ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে যার আকার ছিল ছয় লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার।
তার আগের দুই অর্থবছরে ছিল যথাক্রমে ২০২১-২২ অর্থবছরে যা ছিল ছয় লাখ দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকার। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাজেটের আকারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটটি করতেই হবে। এই বাজেট হতে যাচ্ছে বিশাল একটি বাজেট। এবং এর বাস্তবায়ন অবশ্যই চ্যালেঞ্জের। এ কারণে জোর দিতে হবে বাজেট বাস্তবায়নের ওপর। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার বাজেট ঘোষণা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। বাজেট একটি দেশের আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক। বাজেট প্রণয়ন নয় বরং বাজেট বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ হয় সরকারের জন্য। প্রান্তিক জনসাধারণের কাছে বাজেটের সুফল পৌঁছানো এবং দেশকে গতিশীল অভিমুখে ধাবিত করাই বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য থাকে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই বাজেট ঘোষিত হয়। এই মুহূর্তে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাজার নিয়ন্ত্রণ বা মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানা। বাজেট ঘোষণা হওয়ার আগে থেকেই মিডিয়াসহ সর্বত্র বাজেট নিয়ে আলোচনা হয়। আসছে বাজেট কেমন হবে এবং বিগত বাজেট কেমন ছিল বা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা নিয়েই এসব আলোচনা চলে। অর্থনীতি গতিশীল করতে এবং মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে এই বাজেট সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে বলেই বিশ্বাস।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। সেই বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। তারপর দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। বহু উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ হওয়ার কাতারে দাঁড়িয়ে। সময়ের সঙ্গে যেমন বেড়েছে লোকসংখ্যা, বেড়েছে প্রয়োজন আর সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাজেটের আকার। বাজেটের সঙ্গে দেশের জনগণের জীবনমান ওতপ্রোতভাবে জড়িত; দেশের উন্নয়ন জড়িত। ফলে বাজেট একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাজেটের প্রভাব পরে বাজারে।
কারণ বাজেটে কোন কোন জিনিসের দাম বাড়বে বা কমবে তা স্থির করা হয় এবং মিডিয়ার কল্যাণে সেসব একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের ক্রেতা ও বিক্রেতারাও সেটি পড়ে থাকে। বাজেটের পর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিও আমাদের দেশের একটি সাধারণ ঘটনা। এমনকি দাম বাড়ার কথা শুনেও অনেকে দাম বাড়িয়ে দেন। ফলে মূলত এর ঝামেলায় পড়েন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষেরা। কারণ এমনিতে সারা বছর তাদের হাতের অবস্থা টালমাটাল রয়েছে। এরমধ্যে আবার বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে তা আরো খারাপ অবস্থার সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতির হার ছিল নয় দশমিক ৩০ শতাংশ। সুতরাং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে জনগণের জীবনমান বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলা বিশেষত মানুষের জীবন ও জীবিকা সহজতর বা চাপ কমানোর প্রচেষ্টাই বেশি প্রাধান্য পাবে।
এরপরই আসে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের বিষয়। এর প্রথমেই রয়েছে কর্মসংস্থান। বেকারত্ব সমস্যা স্বাভাবিক সময়েই অধিকাংশ দেশের জন্যই মাথা ব্যথার কারণ। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় বেকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। বেকারত্ব, ক্ষুধা এবং দারিদ্রতা এই তিন ফল আপাত যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পৃথিবী মোকাবেলা করছে এবং আগামী বহু বছর করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক কাজে সংশ্লিষ্ট করা এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন রয়েছে। খাদ্য উৎপাদন এবং মজুদ নিশ্চিত করার জন্য কৃষিতে গুরুত্বারোপ করতে হবে। করোনা ভাইরাসের কারণে যখন অধিকাংশ খাত বিপর্যস্থ হচ্ছে তখন দেশের অর্থনীতির প্রাণ সঞ্চার করার জন্য প্রয়োজন কৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই আমাদের কৃষির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষিই পারে খাদ্য সংকটের মতো পরিস্থিতিতে টিকিয়ে রাখতে।
এসবের সঙ্গে সবচেয়ে শিক্ষা খাতের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। শিক্ষাকে যুগোপযুগী করে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ থাকবে। যতদিন শিক্ষাকে যুগোপযোগী এবং আন্তর্জাতিক মানের করা না যাবে ততদিন দেশ কাক্সিক্ষত সাফল্য পাবে না। প্রয়োজন দক্ষ ও পর্যাপ্ত শিক্ষকের। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। ফলে এ খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। বাজেটের সফলতা নির্ভর করে বাজেট বাস্তবায়নের ওপর। সেটি কতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে সেটি বিবেচ্য। বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা শক্তিশালী করতে হবে। পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়তো সম্ভব নয় তবে যত কাছাকাছি বাস্তবায়ন করা যায় ততই বাজেটের সুফল সাধারণ জনগণ ভোগ করবে।
অলোক আচার্য : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ