বলতে গেলে প্রায় সব কবিই প্রেমের কবি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। বিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও কবির জীবনেও প্রেম এসেছে বার বার। দ্রোহের পাশাপাশি প্রেম তার গল্প-গানে-কবিতায় হয়ে উঠেছে প্রবল। নজরুলের অসংখ্য লেখায় বিরহ অভিমান আর অতৃপ্তির রূপ ফুটে উঠেছে অবলীলায়। তিনি মিলনের নন, বিরহের কবি। নজরুলের জীবনের প্রেম বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে অনন্য মাত্রা। তার প্রেম ছিল মোহমুগ্ধতা, যন্ত্রণা, বিরহ আর সৌন্দর্যে ভরপুর। বিদ্রোহী কবি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু তার জীবমে প্রেম-ভালোবাসার বেশির ভাগ রচিত হয়েছিল বাংলাদেশে। জোয়ার-ভাটার মতো তার জীবনে প্রেম এসেছে প্রবল বেগে, মজেছেন তুমুল প্রেমে। নজরুল সাহিত্যে তেজোদীপ্ত চেতনার পাশাপাশি নারীর প্রেম চেতনা এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। নজরুলের জীবনে প্রেমের হাওয়া এসেছে বার বার। নারীর সঙ্গে জড়িয়েছেন নিজের জীবন। তবে যে তিনজন নারীর সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলেন তারা হলেন- নার্গিস, প্রমিলা এবং ফজিলাতুন্নেসা। এ ছাড়া আরো কয়েকজন নারীর সাথে তার সম্পর্কের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
বিদ্রোহী কবির জীবনে প্রথম প্রেমের পরশ নিয়ে আসেন কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের মেয়ে নার্গিস। নার্গিসের প্রকৃত নাম সৈয়দা খানম। নার্গিস আসার খানম। নার্গিস কলকাতার পুস্তক প্রকাশক আলী আকবর খানের বিধবা বোনের মেয়ে। কলকাতায় আলী আকবর খানের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে তার সাথে কবি ১৯২১ সালে কুমিল্লায় গেলে সেখানে নার্গিসের সাথে পরিচয় প্রেম ও বিয়ে হয়। নজরুলকে নিয়ে আলী আকবর খান কুমিল্লায় তার বন্ধু বীরেন্দ্র কুমার সেন গুপ্তের বাড়িতে উঠেন। কয়েকদিন পর মুরাদনগরের দৌলতপুর খাঁ বাড়িতে যান কবিকে নিয়ে। সেখানে কবি কবিতা আর গানে সকলকে মুগ্ধ করেন। আকবর আলী খানের বোনের মেয়ে নার্গিস ছিল পাশের খাঁ বাড়িতে। নার্গিসের মা আসমাতুন্নেসা আর বাবা মরহুম মুন্সী আব্দুল খালেক। একদিন খাঁ বাড়ির দীঘির ঘাটে কবির বাঁশী শুনে মুগ্ধ হয়ে যান নার্গিস। এরপর পরিচয় হয়, শেষে প্রেমে পড়েন। আকবর আলী খানের উদ্দেশ্য ছিল তার কোনো আত্মীয়ের সাথে কবির বিয়ে দিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তার প্রকাশনা ব্যবসার উন্নতি করা। এক পর্যায়ে কবি নার্গিসের প্রেমে পাগল হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিলে আলী আকবর খান তা লুফে নেন এবং শেষ পর্যন্ত তাদের বিয়ে হয়। কিন্তু কাবিননামা সম্পাদনের সময় কবিকে ঘরজামাই থাকতে হবে এ শর্ত দিলে কবি রাগে বিয়ের রাতেই নার্গিসকে ছেড়ে পালিয়ে চলে যান। এর পর ষোল বছর কবির সাথে নার্গিসের কোনো যোগাযোগ হয়নি। এরপর নার্গিস কবিকে একটি চিঠি লিখলে কবি সেই চিঠির জবাব দিয়েছিলেন একটি গান দিয়ে-
‘যার হাতে দিয়ে মালা দিতে পার নাই/কেন মনে রাখ তারে , ভুলে যাও তারে, ভুলে যাও একেবারে,/আমি গান গাহি আপনার দুঃখে/তুমি কেন আসি দাঁড়াও সন্মুখে/আলেয়ার মতো ডাকিওনা আর নিশিথ অন্ধকারে।’
এরপর দুজনের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু প্রথম প্রেম কবির মনে দাগ কেটেছিল দারুনভাবে। কবি বিষণ্নতায় ডুবে যান। নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে কবি বেশ কয়টি কবিতা লিখেছিলেন। তন্মধ্যে হার মানা হার অন্যতম- ‘...আমায় বাঁধতে যারা এসেছিল গরব করে হেসে/তারা হার মেনে হায় বিদায় নিল কেঁদে/তোরা কেমন করে ছোট বুকের একটু ভালবেসে/ওই কচি বাহুর রেশমী ডোরে ফেললি আমায় বেঁধে...।’
কবি নজরুল আলী আকবর খানের সাথে কুমিল্লায় প্রথম যে বাসায় উঠেছিলেন সেই বাড়ির মালিক বিরজা সুন্দরী দেবী কবিকে পুত্রসম স্নেহ করতেন। কবিও তাকে মা বলে সম্বোধন করতেন। নার্গিসের বাড়ি থেকে পালিয়ে কবি সেখানে যান। পরবর্তীতে আরো কয়েকবার সেখানে যান কবি। সেখানে বিরজা দেবীর জ্যা গিরিজা বালার কন্যা আশালতা ওরফে প্রমিলার সাথে পরিচয় ও পরে প্রণয় গড়ে উঠে এবং একদিন প্রমিলাকে বিয়ে করেন। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল কলকাতায় বিয়ের সময় ধর্ম বাধা হয়ে দাঁড়ালেও শেষ পর্যন্ত নিজ নিজ ধর্ম বজায় রেখে বিয়ে সম্পন্ন হয়। প্রমিলাও কবির সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে যান। নজরুল তার বিভিন্ন কবিতায় প্রমিলার প্রতি প্রেমের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বিজয়িনীর দোদুল কবিতায় প্রমিলার রপের বর্ননা দেন কবি এভাবেÑ ‘মৃনালু হাত নয়ানু পাত/গালের টোল চিবুক দোল/সদা কাছে করায় ভুল/প্রিয়ার মোর কোথায় তুলে/.../কাঁকন ক্ষীণ মরাল গ্রীবা।
শয্যাশায়ী সঙ্গিনী প্রমিলাকে উদ্দেশ্য কবি লিখেছিলেন- ‘অরুণ তুমি তরুণ তুমি, করুণ তার চেয়েও/হাসির দেশে তুমি যেন বিষাদ লোকের মেয়ে।’
সওগাত পত্রিকার লেখিকা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান স্নাতকোত্তর ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার প্রতি কবির প্রেম ছিল কিংবদন্তিতুল্য। তবে ফজিলাতুন্নেসার প্রতি কবির প্রেম ছিল এক তরফা। ফজিলাতুন্নেসাকে কবি কখনো আপন করে পাননি, তবু ভালোবেসেছেন পাগলের মতো। বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে তার সাথে কবির পরিচয় হয়। কবির হাত দেখার অভ্যাস ছিল। কাজী মোতাহার হোসেন কবিকে ফজিলাতুন্নেসার বাসায় নিয়ে গেলে সেখানে কবি তার হাত দেখেন। হাত দেখতে গিয়ে চোখে চোখ পড়া, গড়ায় প্রেমে। অবশেষে তার প্রেমে মজে যান। সেখান থেকে চলে আসলেও কবির মনে থেকে যায় ফজিলাতুন্নেসা। মোতাহার হোসেনের কাছে লেখা চিঠি ফজিলাতুন্নেসাকে দেখাবার অনুরোধ জানান। ফজিলাতুন্নেসার কাছেও কবি চিঠি দিতেন বন্ধুর মাধ্যমে। শেষে কবির লেখা একটি চিঠির জবাব দেন ফজিলাতুন্নেসা এবং সে চিঠিতে কবিকে আর চিঠি না দেওয়ার অনুরোধ জানান। কবি কথা দিয়েছিলেন আর চিঠি লিখবেন না, কিন্তু কথা রাখতে পারেননি। এরপরও লিখেছিলেন বন্ধুর কাছে। ফজিলাতুন্নেসার কাছ থেকে বার বার ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেও কবি তাকে চিঠি লিখেছিলেন। কাজী মোতাহার হোসেন নজরুলের লেখা চিঠি সৈয়দ আলী আশরাফকে দিলে তিনি নজরুল জীবনে প্রেমের অধ্যায় গ্রন্থে প্রকাশ করেন এই চিঠি।
সৈয়দ আলী আশরাফ নজরুলের চিঠি পড়ে তাকে প্রেমের পূজারী বলে উল্লেখ করেছিলেন। ১৯২৮ সালে ফজিলাতুন্নেসার বিলেত গমণ উপলক্ষে বিদায় সংবর্ধনায় কবি তার উদ্দেশে একটি গান পরিবেশন করেন- ‘জাগিলে পারুল কিগো সাত ভাই চম্পা ডাকে/উদিল চন্দ্রলেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে/চলিলে সাগর ঘূরে অকাল মায়ার পুরে/ফুটে ফুল নিজ যেথায় জীবনের ফুল্লু শাখে।/থেকো নাকো স্বর্গ ভুলে এ পারের মর্ত্যকুলে/ভিড়ায়ো সোনার তরী আবার এ নদীর বাঁকে।’
বিলেতে ফজিলাতুন্নেসার বিয়ে হয়ে গেছে শুনে কবি গান লিখেন- ‘বাদল ঝড়ে মোর নিভে গেছে বাতি/তোমার ঘরে আজ উৎসবের রাতি।/তোমার আছে চাঁদ আমার মেঘের রাতি/তোমার আছে ঘর ঝড় আমার সাথী।’
ফজিলাতুন্নেসার প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কবি খোদার প্রেমে মশগুল হয়ে লেখেন- ‘পর জনমে দেখা হবে প্রিয়/ভুলিও মোরে ভুলিও/এ জনমে যাহা বলা হল না/জানাইলে প্রেম করিও ছলনা/যদি আসি ফিরে বেদনা দিও/হৃদয়ে যেথায় প্রেম না শুকায়/সেই অমরায় মোরে স্মরিও।’
এ তিন জন ছাড়াও কবি যাদের সান্নিধ্যে জড়িয়েছিলেন তারা হলেন রানু সোম, উমা মৈত্র, জাহানারা বেগম, শিল্পী কানন বালা দেবী।
ঢাকার টিকাটুলিতে গান শেখাতে গিয়ে কবি রানু সোমের প্রেমে পড়েন কবি। রানু সোম পরবর্তীতে কবি বুদ্ধদেব বসুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন নাম হয় প্রতিভা বসু। গুরু শিষ্যের সুন্দর সম্পর্কের মাঝে শুরু হয় নানা কানা ঘোষা। মুসলমান কবি হিন্দু যুবতীকে গান শেখাতে গিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলে একদিন রানু সোমের বাসা থেকে রাতে ফেরার পথে একদল যুবক কবিকে আক্রমণ করেছিল। রানু সোম কবিকে গুরু জ্ঞানে ভক্তি করতেন। অনেকের মতে তাদের মধ্যে কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না।
নার্গিস, প্রমিলা ও ফজিলাতুন্নেসার সাথে কবির জীবনে উমা মৈত্রের নামও উচ্চারিত হয়। অনেকে মনে করেন নজরুলের শিউলি মালা গল্প উমা মৈত্রের স্মৃতি নিয়ে রচিত। উমা মৈত্রকে কবি গান শেখাতেন। উমা মৈত্র তৎকালীন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্র নাথ মৈত্রের মেয়ে যার ডাক নাম ছিল নোটন। শিউলি মালা গল্পে কবি লিখেছেনÑ একজন অসীম আকাশ, অন্যজন অতল সাগর। কোনো কথা নেই, কোনো প্রশ্ন নেই, শুধু এ ওর চোখে, ও এর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে।
অনেকে জাহানারা বেগমের সাথে কবির সম্পর্ক ছিল বলে মনে করেন। বর্ষাবাণী নামক বার্ষিক পত্রিকার সম্পাদিকা জাহানারা বেগমের সাথে কবির প্রথম পরিচয় হয় দার্জিলিং-এ ১৯৩১ সালে। জাহানারা বেগমের কাছে সংরক্ষিত কিছু গান ও কবিতা ছিল যার মধ্যে জাহানারা বেগমকে নিয়ে লেখা কয়েকটি কবিতা ছিল। তবে কবি জাহানারা বেগমকে ভালোবেসেছিলেন কিনা তা জানা যায়নি তেমনভাবে।
শিল্পী কানন দেবীকেও কবি গান শেখাতেন। তাকে নিয়েও মুখরোচক কাহিনী রটেছিল। এমন কথা প্রচলিত ছিল যে- কবিকে কলকাতায় কোথাও না পাওয়া গেলেও কানন দেবীর বাড়িতে পাওয়া যাবে অবশ্যই। বাস্তব হয়তো অন্যরকম ছিল।
সত্য ও সুন্দরের কবি আজীবন প্রেমের কাঙাল ছিলেন। তাই প্রেম এসেছিল তার জীবনে বার বার। কখনো ঝড়ের মতো, কখনো নিভৃতে, কখনো মনের অজান্তে। নারীকে ভালোবাসার সাথে সাথে কবি ভালোবেসেছিলেন মানুষকে মানবতাকে, সত্যকে। মানবিক প্রেমকে ভালোবাসার অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন কবি। বাক শক্তি হারাবার পূর্বে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির বিশেষ সভায় কবির মুখ থেকে নিসৃত হয়েছিল- ‘আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম নিতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’ কবি যেমন ছিলেন বিদ্রোহী তেমনি ছিলেন প্রেমের পূজারী।
আজকালের খবর/আরইউ