বুধবার ৪ অক্টোবর ২০২৩
জলিল সাহেবের পিটিশন : হত্যাযজ্ঞের বিচারের স্বপ্ন দেখায়
অলোক আচার্য
প্রকাশ: শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০২৩, ৩:৩৭ PM
জলিল সাহেব প্রয়াত নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ নামের একটি ছোট গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। একজন বয়স্ক মানুষ, দু’জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত পিতার চরিত্র যার অন্তরজুড়ে পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা এবং সেই ঘাতকদের বিচারের দাবিতে ঘরে ঘরে যাওয়ার, তাদের বোঝানোর এবং তাদের স্বাক্ষর আদায়ের কাহিনী। একটি ছোট গল্পের যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা দরকার বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ছোটগল্প নিয়ে বলা কথা- ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা নিতান্তই সহজ সরল’। আর শেষের বৈশিষ্ট্যটি হলো শেষ হইয়াও যেন হইলো না শেষ। 

জলিল সাহেবের পিটিশন গল্পটি এমনই। শেষ পর্যন্ত জলিল সাহেব কতগুলো স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে পেরেছেন সেই তথ্য জানার আগ্রহ থেকে যায়। আবার মনে হয় যদি সত্যি সত্যি জলিল সাহেবের মতো কেউ একজন ঘাতকদের বিচারের দাবিতে এভাবে স্বাক্ষর সংগ্রহে নেমে পরতো তাহলে হয়তো তার সঙ্গে আরো অনেকেই আসতো। যদিও গল্পের জলিল সাহেবের সঙ্গে কেউ আসেনি। লেখক নিজে কিছুটা উদ্যোগী হয়েছিলেন বটে, তবে নানা কাজের চাপে সেটিও আর হয়ে ওঠে না। এক সময় জলিল সাহেব মারা যান। তিনি তার নাতনির মধ্যেও সেই বিশ্বাস দিয়ে যান যে একদিন না একদিন সেই স্বাক্ষরের ফাইল নিতে কেউ আসবে। এখানে সময় বাস্তবতার বিষয়টি উঠে আসে। শেষ পর্যন্ত ফাইল নিয়ে আর কেউ স্বাক্ষরের জন্য বের হয় না। জলিল সাহেব পিটিশন দায়ের করতে চান তার দুই সন্তান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন শুধু সে জন্য নয়, যে নির্মম অত্যাচার তারা চালিয়েছিল তার বিচারের জন্য। 

তার উক্তি হলো, ‘ত্রিশ লাখ লোক মরে গেলো, কোনো বিচার হলো না। মনে হলে বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা হয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলা সাহিত্যের একটি বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে। সেই অংশে রয়েছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, ছড়া ইত্যাদি আরো শাখা। এর মধ্যে রয়েছে কিছু সৃষ্টি কালজয়ী। এসব কালজয়ী সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব পেয়েছে। যাদের হাত ধরে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে তিনি বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তির নাম হুমায়ূন আহমেদ। যার হাতের ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে গল্পের ধারা। নাটকে পেয়েছে নতুনত্বের স্বাদ এবং সিনেমার পর্দায়ও দর্শকের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। পাঠক নন্দিত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে এমন কিছু চরিত্র সৃষ্টি করে গেছেন যা প্রতিনিয়ত সাহিত্যপ্রেমীদের প্রভাবিত করে।

হুমায়ূন আহমেদের কাজ, তার সৃষ্টি বিশাল। হুমায়ূন আহমেদকে স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন বলতে যাকে বোঝায় তিনি ছিলেন সেরকম মানুষ। তিনি ছোটগল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তিনি উপন্যাস, নাটক এবং চলচ্চিত্র জগতে এদেশে নতুন যুগের সূচনা করেছেন। কোথাও কেউ নেই নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি না দেওয়ার দাবিতে মিছিল হয়েছে। যা দেশের নাটকে একটি ইতিহাস।  

মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও লেখকের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক এবং চলচ্চিত্র রয়েছে। এর মধ্যে একটি ছোটগল্প হলো ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’; যা অন্য গল্পগুলো থেকে একটু ভিন্ন। একটি ছোটগল্প কিন্তু এত বড় একটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে গল্পটি রচিত হয়েছে যে এই গল্পটি তাই অন্য গল্প থেকে স্বতন্ত্র্য। গল্পটি লেখকের ‘শীত ও অন্যান্য গল্প’ নামক ছোটগল্প সংকলনে রয়েছে।

‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ গল্পটি কেন অন্যসব থেকে আলাদা তার প্রধান ব্যাখ্যাই হলো গল্পের প্রধান চরিত্র জলিল সাহেব নামের এই বয়স্ক ভদ্রলোক আমৃত্যু চেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে যে ৩০ লাখ মানুষকে নির্মমভাবে পাকিস্থানি সেনাবাহিনী হত্যা করেছে সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক। এই পিটিশন অন্যায়কারীর বিচারের পিটিশন। তারা শাস্তির মুখোমুখি হোক। অত্যন্ত সাবলীল বর্ণনায়, বাস্তবতায় গল্পটি এগিয়ে গেছে। গল্পে বর্ণনাকারী বা লেখকের ভূমিকা একজন প্রফেসরের। গল্পের শুরুতেই জলিল সাহেবের উপস্থিতিতে বিরক্ত হলেও পরে নিজেও বিষয়টি নিয়ে একমত হন। যদিও জলিল সাহেবের মৃত্যুর পর এবং সময়ের বাস্তবতায় এটি শেষ হয়নি। নতুন পাড়ায় এসে লেখক বাসা ভাড়া নেওয়ার পরই জলিল সাহেব নামের এই মানুষটি লেখকের কাছে আসেন। 

জলিল সাহেবের দুটো ছেলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধার বাবা যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তিনি বিচার চান এই নৃশংসতার। এই পিটিশনে স্বাক্ষর করতে গিয়ে সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে তিনি হাজির হয়েছেন। বিচারের পক্ষে পিটিশনের ফাইল নিয়ে তাতে স্বাক্ষর নিয়েছেন। অনেকেই স্বাক্ষর করেননি। এত বছর পর এটা নেহায়েতই ঝামেলা মনে করে জলিল সাহেবকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। বারবার গেছেন, বুঝিয়েছেন। সময়ের সাথে সাথে যে পরিস্থিতি কীভাবে পরিবর্তন হয়ে যায় তা বোঝা যায় এই গল্পে। জলিল সাহেবের পিটিশনের বিষয়বস্তু ছিল, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে দশ লাখ ইহুদি মারা গিয়েছিল। সেই অপরাধে অপরাধীদের প্রত্যেকের বিচার করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কিন্তু এ দেশের ত্রিশ লাখ মানুষ মেরে অপরাধীরা কী করে পার পেয়ে গেল? কেন এ নিয়ে আজ কেউ কোন কথা বলছে না? এই প্রশ্ন আমাদেরও থাকা উচিত ছিল? 

লেখক যা গল্পের জলিল সাহেবের মাধ্যমে বলেছেন। এত বড় একটি হত্যাকাণ্ড করে তারা পার পেয়ে গেলো। গল্পে জলিল সাহেব তার দীর্ঘ পিটিশনে সরকারের কাছে আবেদন করেছেন যেন এদের বিচার করা হয়। একটি বর্বর হত্যাকাণ্ড এবং সেই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য জলিল সাহেবের মতো একজন বয়স্ক মানুষ একা একা যে লড়াইয়ে নেমেছিলেন তা তিনি হয়তো শেষ করতে পারেননি। কিন্তু তিনি একটি স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। তার মৃত্যুর আগে তিনি বত্রিশ হাজার মানুষের স্বাক্ষর নিতে পেরেছিলেন। এই যে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘোরা তা আমাদেরও প্রশ্ন জাগায়, কেন বিচার হবে না? 

এই একটি গল্পে তুলে এনেছেন সব। দু’জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার বাবা হিসেবে তিনি নিজের বিবেকের প্রশ্নেই এ কাজটি করছেন। গল্পের এক অংশে এতদিনে পুরোনো ঘটনা ঘাটতে তাকে নিরুৎসাহিতও করা হয়। বিনিময়ে তাকে দু’সন্তানের শহীদ হওয়ার বিপরীতে বাড়ি পাওয়ার দাবির কথা বলেন। কিন্তু তিনি এসবের কিছুই চান না। তিনি চান বিচার। একটি গল্প কেবল গল্পই থাকে না। তা হয়ে ওঠে মানুষের মনের কথা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে নৃশংস, বর্বর হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল পাকিস্থান সেনাবাহিনী তার বর্ণনা বহু গল্পে উপন্যাসেই আছে তবে তাদের বিচারের জন্য এই সংগ্রাম ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ গল্পটিতে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।  

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
পি কে হালদারসহ ১৪ জনের মামলার রায় ৮ অক্টোবর
পোলিং এজেন্টদের ভূমিকা যথাযথ হলে কারচুপি পরাভূত করা সম্ভব: সিইসি
পুলিশ হেফাজতে সাবেক দুদক কর্মকর্তার মৃত্যুর অভিযোগ
সূচকের মিশ্র প্রবণতায় শেয়ারবাজারে লেনদেন চলছে
নাইজেরিয়ায় অবৈধ তেল শোধনাগারে বিস্ফোরণে নিহত ৩৭
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কবি নজরুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত
‘আমেরিকার সঙ্গে আওয়ামী লীগের আপস হয়ে গেছে, আর স্যাংশন আসবে না’
শর্ত মেনেই শুটিংয়ে রাজি সায়ন্তিকা!
সেলিব্রেটিদের মারামারির ভিডিও প্রকাশ করলেন রাজ রিপা
মুক্তিপণ না পেয়ে শিশুকে হত্যা, মরদেহ মিললো ডোবায়
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft