ঢাকাসহ কয়েকটি জেলা শহরে ‘দামাল’ সিনেমাটি প্রদর্শিত হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত তরুণ দর্শকের সমাগমের পাশাপাশি মধ্যবয়সীরাও বসেছেন সিনেমা দেখে ইতিহাস ঘাঁটতে। সিনেমাটি ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে ঘিরে আবর্তিত হলেও কৌশলগত কারণে ‘ছায়াবলম্বন’ বলা হচ্ছে। এর কারণ ব্যাখ্যায় নির্মাতা রায়হান রাফীর যুক্তি- ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল’ দলের ইতিহাসটা ‘আমিত্ব’ নির্ভর যে কারণে সবার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে।’
সিনেমাটি মূলত সত্য ঘটনা অবলম্বনে শিশু সাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগরের একটি গল্প থেকে যৌথভাবে নাজিম উদ দৌলা ও রায়হান রাফী চিত্রনাট্যে নির্মিত।
‘দামাল’ ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন বিদ্যা সিনহা মিম, সিয়াম আহমেদ, শরিফুল রাজ, সুমিত, রাশেদ অপু, সাঈদ বাবু, নাজমুস সাকিব, শাহনাজ সুমি, বৃষ্টি, অথৈ, পূজা প্রমুখ।
গত ঈদে একই পরিচালকের ‘পরাণ’ হিট হওয়ার সুযোগটা নিতে মুক্তির পরিকল্পনা নেয় ইমপ্রেস কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে প্রেক্ষাগৃহ রাইটস কিনে নেন রায়হান রাফীসহ অন্যরা। সিনেমা মুক্তিতে নেওয়া হয় প্রচারণার নানাবিধ কৌশল। তবে শত কৌশল অবলম্ব করেও দর্শকের প্রশংসা আদায় ব্যর্থ হয় সিনেমাটি। এ ব্যর্থতার কারণ তিনটি এক. দুর্বল সংলাপ ও নির্মাণ; দুই. অযাতিভাবে নিহত প্রতিপক্ষ সৈন্যদলের ওপর গুলিবর্ষণ যা স্পষ্টতই জেনেভা কনভেনশন আইন লঙ্ঘন; তিন. ইতিহাসের ছায়াবলম্বনের নামে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর নাম পরিবর্তন; যা বিশ^াসযোগ্যতা কুড়াতে ব্যর্থ হয়েছে।
রাফী সিনেমা বানাতে গিয়ে ভুলেছেন ১৯৭১ সালে অপ্রুতুলতার কারণে অহেতুক গুলির বর্ষণের সুযোগ ছিলো না। সেখানে নিহত সৈন্য দলের ওপর সিয়ামের হিরোইটিক লুক দেখাতে ইতিহাস আর ছায়াবলম্বন দুটোকেই অস্বীকার করেছেন, অযাচিত গুলিবর্ষণের বিলাসিতাও দেখিয়েছেন। চরিত্রগুলোর নাম পরিবর্তণকেও দর্শক ভালো চোখে নেননি; কারণ ইতিহাসে যে নামগুলোর সঙ্গে পাঠক পরিচিত সে নামের জায়গায় তারা ভিন্নতা পেয়েছেন। কোচ ছিলেন ননী বসাক (কিংবদন্তি অভিনেত্রী শবনমের বাবা), সিনেমায় তাকে অরুন বসাক বলে ডাকা হয়। এতে শিক্ষিত দর্শকের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
কিছু দৃশ্য সিঙ্ক কন্টিনিউটি বাধাগ্রস্থ হয়েছে কোথাও কোথাও। দুর্বল সংলাপ, ভিএফএক্সের কাজ যে কাঁচা হাতের সেটা ডিজিটাল যুগে বসে ক্লাস টুয়ের বাচ্ছাও বলে দিতে পারে। বরং সে তুলনায় সীমাবদ্ধতার মধ্য থেকে খেলার দৃশ্যগুলো বেশ শিহরিত করেছিলো দর্শকদের। আবহ সংগীতেও উৎড়ে গেছে। সিনেমার প্রাপ্তি বলতে ওতটুকুই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খেলাধুলার দৃশ্যগুলো ‘জাগো’খ্যাত নির্মাতা খিজির হায়াত খান তত্বাবধানে নেওয়া হয়েছিলো। খেলাধুলার জায়গা বাদ দিয়ে পুরো সিনেমাটি ছিলো দুর্বল চিত্রনাট্যের সস্তা গল্প; যা দেখে স্পষ্টতই বলা যেতে পারে ‘দামাল’ মূলত ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ নাম ব্যবহারের সুযোগে ব্যবসা ফাঁদার ফন্দি বৈ অন্যকিছু নয়।
অভিনয় নিয়ে বলতে গেলে সিনেমাতে রাজ তার অভিনয় ক্ষুধার যৎসামান্যই দেখাতে পেরেছিলেন। এতে করেই তিনি সিয়ামকে টেক্কাও দিয়েছেন, পেয়েছেন দর্শকের তালিও। অভিনয়ে গভীরতা থাকলেও দুর্বল সংলাপের কারণে বিদ্যা সিনহা মিমকে দর্শক সেভাবে পায়নি। অর্থাৎ অভিনেত্রী কারিশমার দ্যুতি দেখাতে ব্যর্থই হয়েছেন ‘পরাণ’খ্যাত এই অভিনেত্রী। তবে পর্দায় রাজাকার চরিত্রে নিজের সামর্থের প্রমাণ দিয়ে দর্শকের গালি উপহার পেয়েছেন শক্তিমান অভিনেতা রাশেদ মামুন অপু। অভিনেতা হিসেবে অপুর সার্থকতা এখানেই। তেমনি রায়হান রাফীরও।
ছায়াবলম্বনের নামে ইতিহাস বিকৃত নয়তো?
সিনেমাতে একদল তাজা প্রাণের বীরত্বগাঁথাকে তুলে ধরেছেন আলোচিত পরিচালক রায়হান রাফী। এর প্রচারণায় ‘১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ বাক্য অন্যদিকে ‘আশ্রিত’ বা ‘অনুপ্রাণিত’ শব্দ দর্শক ঘাটাঘাটির মূল কারণ। রাফীর এই প্রচেষ্টা ইতিহাসের আশ্রয়মাত্র। গল্পটা নিজের মতো করেই বানানোর চেষ্টা করেছেন। একটু তাড়াহুড়ো ছিলো বটে, তবে গোল বেধেছে যখন ছায়াবলম্বনকে ইতিহাসের পথে হাঁটিয়েছেন তখন। উল্টো পিরামিডে নিতেই ইতিহাসপ্রিয় দর্শক তেঁতে উঠেছেন। ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর স্পর্ষকাতর এক অধ্যায়। সেখানে অংশ নেওয়া প্রতিটি নাম ও চরিত্র শ্রদ্ধার। এ সকল সিনেমা নির্মাণের আগে যে লেভেলের গবেষণা দরকার ছিলো সিনেমা দেখে মনে হয়েছে অপেশাদার শিল্পীর তুলিতে ক্ষতবিক্ষত ক্যানভাস!
দায় এড়াতে পারে না সেন্সরবোর্ডও!
‘ছায়াবলম্বনের’ নামে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর নাম যেভাবে পরিবর্তনে নো অবজেকশান দিয়ে ‘দামাল’কে সনদ দিয়েছে তাতে সেন্সরবোর্ডের অদক্ষতা স্পষ্ট। যে কারণে ইতিহাস বিকৃতির মতো ভয়াবহ অভিযোগ থেকে সেন্সরবোর্ডও দায় এড়াতে পারে না। তেমনি ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ নিয়ে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক দলিল গ্রন্থণা এখন সময়ের দাবি। নয়তো ছায়াবলম্বের মাঝে ইতিহাস হারিয়ে যাবে।