বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে কবিতা কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট। সম্পাদক ও সমালোচকেরা তাহার বিরুদ্ধে আন্দোলন করিলেও তাহার ব্যতিক্রম হইবার জো নাই। চিত্রেও যেমন, কাব্যেও তেমনি। দূর স্পষ্ট, নিকট অষ্পষ্ট; বেগ অস্পষ্ট, অচলতা স্পষ্ট; মিশ্রণ অস্পষ্ট, স্বাতন্ত্র স্পষ্ট। আগাগোড়া সমস্তই স্পষ্ট, সমগ্র পরিকল্পনা যে কেবল ব্যাকরণের নিয়মের মধ্যে থাকিতে পারে। কিন্তু প্রকৃতিতেও নাই, কাব্যেও নাই। অতএব ভাবুকেরা স্পষ্ট অষ্পষ্ট লইয়া বিবাদ করেন না। তাহারা কাব্যরসের প্রতি মনোযোগ করেন।
তরুণ কবি মিন্টু রায়ের ‘চন্দ্রবিন্দুর বসতি’ ও ‘নীল মেঘ সাদা জল’ কাব্যগ্রন্থদুটি পড়ে কবিতা সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের উক্ত মীমাংসাটুকু বারবার মনে পড়ছিলো। দুটি কাব্যগ্রন্থই উনিশের বই মেলায় ‘ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। দুটি বইয়েরই প্রচ্ছদপট আকর্ষণীয়। হাতে নিলেই পড়তে ইচ্ছে করে। গ্রন্থমেলায় কবি প্রদত্ত বইদুটি পেয়েই আমি বাসায় নিয়ে পড়ে ফেলি। পড়ার প্রধান কারণ মিন্টু রায় ও আমি পাশাপাশি এলাকার বাসিন্দা এবং একই পথের পথিক। তাই ‘জলে ভাসিয়েছি ভাবনার ভেলা...’। সারা জীবনই না খেয়ে, না পরে বই কিনেছি এবং পড়ছি। পড়ন্ত বেলায় ভাবি এতো বই কে সংরক্ষণ করবে? বইয়ের ঠাসাঠাসিতে ঘুমুবার স্থান নেই। তবুও বই সংগ্রহ করি। কেউ উপহার দিলে খুশি হই। সাহিত্যিক বন্ধুরা কোনো বই দিলে পড়ার সময় খুঁজতে চেষ্টা করি বইটিতে বাংলাদেশের কথা আছে তো? একুশের কথা আছে তো? বঙ্গবন্ধুর কথা আছে তো? আছে তো একাত্তর, পচাত্তর এবং বঙ্গ বিভাজনের কথা? গদ্যে হোক পদ্যে হোক কিংবা সে বই কমিকসের হলেও দোষ নেই। কবিতার হলে আরো মজা ও স্বাদ বেশি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীম উদ্দীন, মধুসূদন, জীবনানন্দ, আসাদ, তসলিমা নাসরিনের কথাতো যে কোনো ভাবেই হোক কবিকে প্রভাবিত করবে।
না, মিন্টু রায়ের কবিতায় অস্পষ্টতা নেই। তার কবিতা পড়ে বাক-বিতণ্ডার প্রয়োজন হবে না। তিনি কবিতায় নির্মলেন্দু গুণের মতো সরাসরি কথা বলেছেন। দুটি বইয়ের ফ্লাপ পড়ে সহজেই বইদুটির মূল বক্তব্যের সন্ধান মিলবে। অবশ্য এজন্য পাঠককে সুহৃদ হতে হবে। অন্যকথায় কবির কল্পনা, ভাবনা এবং চিন্তা-চেতনাকে বোঝার জন্য কাব্যরসিক হতে হবে। যা বিশ্বকবি দৃঢ়ভাবে বলেছেন।
‘চন্দ্রবিন্দুর বসতি’ : চন্দ্রবিন্দুর বসতিতে সংকলিত হয়েছে মোট আটচল্লিশটি কবিতা। এ গ্রন্থটি ‘নীল মেঘ সাদা জল’ থেকে একটু ভিন্ন মেজাজের। জীবন জিজ্ঞাসার উত্তর ভগ্নরূপে ছন্দিত। চন্দ্রবিন্দুর বসতি প্রয়োগে সঠিক কাব্যছবি আঁকা হলেও অন্তরে গুঢ় রহস্য থেকেই যায়। অনন্তকাল সাধনা করেও তার হদিস মেলে না। কাব্যপাঠক এখানে গৌন, কবিই মুখ্য। তাই কবিকেই বলতে হয়- ‘শুধু এক শিকড় মাটি দাও.../দুঃখের বসন্ত ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে রব না হয় জনম জনম,/কিংবা গা ভাসাবো দিকভোলা অচেনা গ্রহের কোনো বসন্ত আশায়।’
এই গ্রন্থের প্রথম কবিতাটি শেষ কটি পঙ্ক্তি এরকম। এরকম অনেক প্রিয় পঙ্ক্তি যোগে কাব্য শরীর নির্মাণ করেছেন কবি অন্য অনেকগুলো কবিতার যেমন- রোহিঙ্গাদের নিয়ে- ‘মানবতা তুমি কী!’ শীর্ষক কবিতায়- ‘দেখেছি আবার.../আমি যেন কোনো অসহায় স্বামী-/সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর গর্ভ হতে সন্তানকে আমার;/নরপিশাচ সৈনিকের বুটের আঘাতে/ছিটকে বেরোতে দেখেছি এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে।/দেখেছি, বুনো শাসকের প্রতিটি লাথিতে/বৃদ্ধ পিতার পাঁজড়টা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যেতে,/দেখেছি মাতা ও বৃদ্ধ পিতামহের ধূসর চোখের করুণ আর্তি।’
‘কাঁটাতার’ কবিতাটিও মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি। একটা পৃথিবীতে কত দেয়াল, কত বেড়া, কত হিংসা। এই বইটির আমার প্রিয় কবিতা সেই পৃথিবীকে নিয়ে। কবি এখানে দেয়াল ভেঙেছেন পৃথিবীকে ‘মা’ সম্বোধন করে। সেখানে কাঁটাতারের বেড়া নেই। সংকলিত মুক্তিনিনাদ, অন্ধকূপ, ভালোবাসার বিশ^াস, বাজার কুড়ানো বুড়ি, সম্প্রীতি, দিকশূন্য নান্দনিকতা, ফাঁসির মঞ্চে মানবতা ও বিয়োগ বাঁধন কবিতাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ্য। অনেকগুলো কবিতায় কবির অপ্রাপ্ত বা না পাওয়ার বেদনা স্মৃতি-বিস্মৃতির ছবি আঁকা হয়েেেছ। কাব্যপ্রেমিকদের কাছে গ্রন্থটি অবশ্যই সমাদৃত হবে।
‘নীল মেঘ সাদা জল’ : ‘বেদনা সর্বগ্রাসী, নীল করে দেহ মন’। এ দুটি পঙ্ক্তি এই বইয়ের প্রথম ফ্লাপের। ফ্লাপে আরো বলা হয়েছে- দগ্ধিভূত জীবন বদলায়; জীবনও জলরং ধারন করে বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে। এ গ্রন্থটি বঙ্গবন্ধু এবং মহান ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে রচিত দুটি কবিতা ছাড়া আর প্রায় সকল কবিতায় বিষয় আশয় মানব জীবনকে নিয়ে লেখা। এখানে মুক্তি নেই। তবে পরিত্রাণের প্রচেষ্টা চলে। সে এক অচেনা জীবন কাব্যের অচেনা প্রচ্ছদ। ভূমিকা লিপিতে কবি মিন্টু রায় আরো লিখেছেন- ‘আজ এ পথ চলা কেবলই অমন সব নির্জলা সত্যকে তুলে এনে অনাশ্রিত মনের একটু অশ্রয় খোঁজা’। এখানে কাব্যের চৌষট্টিকলা খোঁজা নিরর্থক। কাব্যের ব্যকরণও অর্থহীন। চাই শুধু রসের প্রবাহ। নান্দনিক রস কিংবা বাস্তবতা ‘বিব্রত মন্বন্তর’ কবিতাটিতে স্পষ্ট! কবিতাটির শেষ কটি পংক্তি কী সুন্দর! ‘তিল পরিমাণ খোরাকিতেই ঢেউ তুলে-/উপড়ে নিতে চায় পৃথিবীর শিকড়-বাকড়।/তাকেই বলবে কি কেউ হৃদয় বদল!/না কি নিঃশব্দেই এক হয়-/দুই বুকে বয়ে চলা হৃৎপিণ্ডের যত নিবিড় স্পন্দন।’
‘মানবতার ডাক’ কবিতাটিও একটি হৃদয়গ্রাহী কবিতা। অনুরূপ কবিতা- ঐক্য শক্তি, জোড়াতালির, ধুঁকে চলা, নিঃশ্বাস পোড়াসুখ, স্মৃতির দোলন, জিজ্ঞাসা, ষষ্টির শক্তি পরীক্ষা, মেঘের কফিন, উচিতে বিপদ, নসু কবিরাজ, ভাগের বাবা, জীবন, হাতকড়া, দুখাই, ইনভেলাপ। এ বইটির বেশকিছু কবিতা বেশ দীর্ঘ ও মিলবদ্ধ। কিছু কবিতায় গল্প আছে ছন্দের সুষম দোলায়। ‘একুশ আমার’ বাঙালির জাগরণের প্রথম সোপান । কবি লিখেছেন- ‘একুশ সে তো প্রচ্ছদে ঢাকা সজীব ভালোবাসা,/আবেশে ঘেরা প্রেয়সীর চোখে স্বপ্ন সুখের ভাষা।/একুশ আমার প্রথম দেখা বাংলা মায়ের কোল,/গ্রামের মেলায় পুতুলনাচ আর নাগরদোলার দোল।/একুশ আমার প্রথম প্রেমের প্রথম প্রণয় ক্ষণ,/অবুঝ শিশুর প্রথম দাঁতের খিল খিল শিহরণ।’
অনুরূপভাবে ‘পিতার দান’ কবিতটিও ভাব, ভাষা, উপমা এবং বাঙালি জাতিরসত্তার প্রতীক। তেমনি ‘পিতার তর্জনী’ শীর্ষক কবিতায় কবি যুদ্ধ জয়ের চিত্র এঁকেছেন। এঁকেছেন ৭ মার্চের সেই মহাকাব্যিক বিবরণ। কবি মিন্টু রায় লিখেছেন- ‘বিচিত্র বৃক্ষরাজির শিকড়-বাকড়/আরো শক্তভাবে আরো আপন করে কামড়ে ধরেছিল এ মাটিকে।/প্রেয়সীর ভেজা চুলের গন্ধে টইটম্বুর মাতাল বাতাস,/শিমুল পলাশের বুকে রঙয়ের মূর্ছনা,/ফুলে ফুলে ভ্রমরের মাতাল পরাগায়ন।/পাখিদের কাকলিতে মুখরিত চারদিক,/নির্ভয় মায়ের আঁচলে শিশুর আরাম খুঁজে পাশ ফিরে শোওয়া।/শুধু একটু তর্জনীর কম্পনে কেঁপে উঠেছিল সারা দেশ,/আমজনতা মেতেছিল জয়ের নেশায়।/হাতের মুঠোয় নিয়েছিল প্রাণ,/ঘর থেকে বাহির হওয়া যুদ্ধ জয়ের প্রবল খেলায়-/সেদিনে পিতার সেই একটি মাত্র তর্জনী সংকেতে/আমাদের ঘরে স্বাধীনতা গেড়েছিল চির বসতি।’
এভাবে কবির অনেক কবিতার উদাহরণ উপস্থাপন করা যায়। তাতে মূল বইটি পাঠের আগ্রহ আরো বাড়বে। মোট কথা ‘চন্দ্রবিন্দুর বসতি’ ও ‘নীল মেঘ সাদা জল’ গ্রন্থদুটিতে তিনি জীবনের কঠিন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন। মূলত দুটি গ্রন্থেই জীবন বোধের স্বচ্ছবলয় আবিষ্কার করেছেন। বই দুটি তিনি তার বাবা-মা, দাদা-দিদি এবং স্ত্রী ও তার প্রিয় সন্তান শুভায়ণ, শ্রেষ্ঠায়ণকে উৎসর্গ করেছেন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস মিন্টু রায়ের এই কাব্যসাধনা আমাদের সাহিত্য জগতের ভাণ্ডারকে পূর্ণ করবে।
আজকালের খবর/আরইউ