ভৈরবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ২২ জন। দিনটি ছিল ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিন বঙ্গবন্ধু প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা ছিল ২২ জন নেতাকর্মীর অপরাধ। এদিন পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠায়। পরে দীর্ঘদিন তারা কারাভোগ করার পর পর্যায়ক্রমে কারাগার থেকে মুক্তি পান। ঘটনার ৪৬ বছর অতিবাহিত হলেও এখন আর তাদেরকে কেউ স্মরণ করে না। সেদিনের গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্য ইতোমধ্যেই কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেছেন। ওইদিন গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্য আমিও ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের অপরাধে আমি পাঁচ মাস ২৭ দিন কারাগারে ছিলাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করার পর দেশের অনেক স্থানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীরা সামরিক সরকারের ভয়ে পালিয়ে ছিলেন। তৎসময়ে দেশে বঙ্গবন্ধুর নামটি উচ্চারণ করতে অনেকে ভয় করতেন। ঘটনার এক বছর পর ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট দিনটি যখন এল ভৈরবে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করব। সেই সময়ে ভৈরব উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ফখরুল আলম আক্কাছ। আমি তখন হাজি আসমত কলেজের ছাত্র। আক্কাছ ভাই আমাদের ছাত্রলীগ, যুবলীগের কয়েকজনের সাথে আলোচনা করলেন বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ভৈরবে হাজি আসমত কলেজের নিউ হোস্টেলে আমরা মিলাদ, দোয়া, কোরআন খতমের আয়োজন করব। ১৫ আগস্ট দিনটি আসার এক সপ্তাহ আগে ফখরুল আলম আক্কাছ ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা গোপনে সভা করে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এই লক্ষ্যে আমরা ভৈরবে গোপনে গোপনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের শতাধিক নেতাকর্মীকে দাওয়াত করি। আমন্ত্রণকারীদেরকে বলা হলো ১৫ আগস্ট বিকেল তিনটার মধ্য হাজি আসমত কলেজের নিউ হোস্টেলে উপস্থিত থাকতে হবে। মৃত্যুবার্ষিকীতে মিলাদ, দোয়া ও কোরআন খতম পাঠ করতে মুছা হুজুর ও ইসরাইল নূরি মৌলানাসহ ১০-১২ জন মৌলভীকে দাওয়াত দেওয়া হলো। আমরা আয়োজনটি খুবই গোপনে করি। আইনশৃংখলা বাহিনী ও প্রশাসন যেন কোনো অবস্থায় জানতে না পারে এই আয়োজনের কথা। কারণ তৎসময়ে দেশে সামরিক সরকার দায়িত্ব পালন করছিল। সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন জিয়াউর রহমান। দাওয়াতের কাজটি আমরা গোপনে করেছি এক সপ্তাহ ধরে।
তারপর দিনটি এল। ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট। দিন গড়িয়ে বিকেল তিনটা বাজল। কলেজের নিউ হোস্টেলে আমরা ২০ কেজি জিলাপী আনলাম। এদিন সাড়ে তিনটার মধ্য মৌলভীরা একে একে উপস্থিত হলেন। তৎসময়ে কলেজের নিউ হোস্টেলটি ছিল ভৈরব বাজার হুলুদ পট্টিতে অবস্থিত। মৌলভিরা উপস্থিত হয়ে কোরআন খতম দিতে লাগলেন। বিকেল চারটার মধ্য আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের ২২ জন নেতাকর্মী হোস্টেলে উপস্থিত হন। অনেক নেতাকর্মী সেদিন সামরিক সরকারের ভয়ে হোস্টেলে আসেননি। কোরআন খতম শেষ হলে আমরা মিলাদ ও দোয়া পড়াব। বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবার ও সেদিন নিহতদের সবার নামে আমরা দোয়া করব। বিকেল চারটা যখন বাজল ঠিক তখন আমাদের সাথে উপস্থিত মাহবুব আলম চিৎকার দিয়ে বলতে লাগল একদল পুলিশ নিউ হোস্টেল ঘেরাও করে ফেলেছে। আমি রুমের ভেতর থেকে চিৎকার শুনে বারান্দায় গিয়ে দেখি পুলিশ অস্ত্রসহ দৌড়ে দুতলায় উঠছে। হোস্টেলটি ছিল দুতলায়। পুলিশ হোস্টেলের ভেতর ঢুকেই প্রথমে ফখরুল আলম আক্কাছ ভাইকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করতে লাগল। এসময় মৌলভিদেরকে কোরআন খতম বন্ধ করতে ধমক দিল পুলিশ। ধমক পেয়ে মৌলভিরা কোরআন খতম বন্ধ করে দিলেন। তারপর উপস্থিত নেতাকর্মীদেরকে লাঠি দিয়ে পেটাতে লাগল পুলিশ। এভাবে মারার ১৫ মিনিট পর সবাইকে বলা হলো থানায় যেতে হবে। পুলিশ তখন বলছিল বঙ্গবন্ধুর নামে মিলাদ পড়িয়েছিস এখন কারাগারে যেতে হবে। এসময় আক্কাছ ভাই পুলিশকে বলেন, আমাদের অপরাধটা কি? তখন পুলিশ বলে থানায় চল, তখন অপরাধ জানতে পারবে। এসময় অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছিল পুলিশ। এরপর আমরা ২২ জনসহ ১০-১২ জন মৌলভিকে পুলিশ থানায় নিয়ে গেল। থানায় নেওয়ার পর মৌলভিদেরকে মুচলেকা রেখে ছেড়ে দিল। আমরা ২২ জনকে একে একে ভৈরব থানার হাজতে বন্দি করল। তৎসময়ে থানার হাজত রুমটি ছিল খুব ছোট। এই হাজতে ৮-২০ জন লোক রাখা যায়। সেখানে ২২ জনকে হাজতে ঢুকানো হলো। আমরা হাজতে ঢুকার পর বসতে পারছিলাম না। অনেকে কষ্টে দাঁড়িয়ে রাত কাটালাম আমরা। পরদিন সকালে জানতে পারলাম ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকাদেশ দিয়ে মামলা হয়েছে আমাদের বিরুদ্ধে। মিলাদ পড়ানোর জন্য পুলিশ কি মামলা করবে, তাই আটকাদেশ দিয়ে তৎকালীন মহকুমা কিশোরগঞ্জ আদালতে আমরা ২২ জনকে চালান দেওয়া হলো। থানা থেকে আমাদের কোমড়ে রশি বেঁধে চালান দেয় পুলিশ। আদালতে জামিন চাইলে বিচারক আমাদেরকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠালেন। কিশোরগঞ্জ কারাগারে যাওয়ার পর আমরা আট জনকে কনডেম সেলে বন্দি রাখল কয়েকদিন। বাকি ১৪ জনকে বিভিন্ন ওয়ার্ডের রুমে বন্দি রাখা হলো। কয়েকদিন কনডেম সেলে রাখার পর আক্কাছ ভাই ছাড়া আমরা সাত জনকে কনডেম সেল থেকে বের করে ওয়ার্ডের রুমে নিয়ে যায়। এভাবে আমি পাঁচ মাস ২৭ দিন কারাভোগ করি। আমাদের মধ্য কেউ কেউ বিভিন্ন মেয়াদে হাজতবাস করে। পরে পর্যায়ক্রমে সবাই জামিনে মুক্তি পান। তবে এই ঘটনায় মামলাটি কয়েক বছর চলমান থাকলে আমরা নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতাম। পরে কয়েক বছর পর সামরিক সরকার আমাদেরকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়।
ঘটনার পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আমরা ভয়ে ভয়ে দিন কাটিয়েছি। সমাজের অনেকেই আমাদেরকে দেখলে ভালো চোখে দেখত না। সেদিন বঙ্গবন্ধুর নামে মিলাদ দোয়া পড়ানোই ছিল আমাদের বড় অপরাধ! মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে সেদিন আমরা যারা পুলিশের হাতে ভৈরবে গ্রেপ্তার হয়েছিলাম তারা হলো যুবলীগ নেতা ফখরুল আলম আক্কাছ, আসাদুজ্জামান ফারুক, যুবলীগ নেতা রুহুল আমিন, মতিউর রহমান, মফিজুর রহমান, জজ মিয়া, জিল্লুর রহমান জিল্লু, মাহাবুব আলম, আসাদ মিয়া, ফিরোজ মিয়া, আতাউর রহমান, ফজলুর রহমান, আসাদুল হক শিশু, আজমল ভূঁইয়া, শাহাজালাল হোসেন, সুবল চন্দ্র কর, দীলিপ চন্দ্র সাহা, দীজেন্দ্র চন্দ্র সাহা, রসরাজ সাহা, আবদুল হামিদ, ইদ্রিস মিয়া ও মাহাবুব।
ঘটনার ৪৬ বছর অতিবাহিত হলেও এখন আর ২২ জনের কথা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করে না। এমনকি ১৫ আগস্টের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা দাওয়াতও পায় না, এমন অভিযোগ তাদের। তারা প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে সেদিনের ঘটনাটি জানাতে চান।
আসাদুজ্জামান ফারুক : সংবাদকর্মী।
আজকালের খবর/আরইউ