
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে দিয়েছে আপন সত্তা। একুশে ফেব্রুয়ারির মাধ্যমেই আমরা অর্জন করেছি স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনা। বাংলা ভাষার মর্যাদার লড়াইয়ে সংগ্রাম করেছে হাজার হাজার বাঙালি। সেই রক্তাক্ত একুশ এখন আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেলেও স্বীকৃতি পেতে কিছুটা দেরি হয়। টাল-বাহানার অবসান ঘটিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি হিসাবে ঘোষণা হয় ১৯৫৪ সালে। পাকিস্তান সরকার প্রকারন্তে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৫৬ সালে। এরপর আর পেছন ফেরার প্রয়োজন হয়নি বীর বাঙালিকে। ২০০০ সাল থেকে এ দিনটিকে সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একযোগে পালিত হওয়ার সিদ্ধান্ত ইউনেস্কো কর্তৃক গৃহিত হয়েছে। তবে সব স্বীকৃতির মাঝে কোথাও যেন একটু অবহেলা, আর সেটা হলো ভাষাকন্যাদের ক্ষেত্রে।
ভাষা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে ‘আমাদের ভাষাকন্যারা’ শিরোনামে শিক্ষাবিদ ড. আনোয়ারা আলম লিখেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, ‘বাঙালির একটা ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙালি বাঁচিবে না’। পরবর্তীতে এ ইতিহাস নিয়ত পূর্ণতার দিকে ধাবমান হলেও যে দিকটি এখনো শূন্য তা হচ্ছে বাঙালি নারীর ইতিহাস। যদিও ইতিহাস নারী-পুরুষের উভয়ের মিলিত কাহিনী। ভাষা আন্দোলনে বাংলাদেশের নারীর যে অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ-তা এখনো এক অজানা বা খণ্ডিত অধ্যায়...। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সূচনা লগ্ন থেকে সবার উপলব্ধিতে যে বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছিল- তা হলো ভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্র। অতএব-এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে নারী ও পুরুষ সবাই। এক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা ছিল বহুমাত্রিক-তথা বুদ্ধিজীবীদের সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নারীর লেখা চিঠি বা প্রবন্ধ বা স্মারকলিপি প্রেরণ, প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং পরোক্ষভাবে সহযোগিতা তথা আর্থিক ও মানসিক সমর্থন।’ (তথ্যসূত্র: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, দৈনিক আজাদী)
স্বাধীনতা সংগ্রামী, ভাষা আন্দোলনের নেত্রী, ও শিক্ষাবিদ এই বিশেষণগুলো যার নামের সাথে স্বর্ণাক্ষরের মতো রয়েছে তিনি হলেন ভাষাকন্যা নিবেদিতা নাগ। তিনি ১৯১৮ সালের ৪ আগস্ট পূর্ব বাংলার বর্তমান নারায়ণগঞ্জের আমলাপাড়ায় মাতামহ আনন্দ রায়ের এক স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম অধ্যাপক সঞ্জীব কুমার চৌধুরী। মায়ের নাম অমিয়াবালা চৌধুরী। সঞ্জীব কুমার চৌধুরী শিক্ষকতা পেশায় কর্মরত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বিপ্লবী নেতা সূর্য সেনের সহপাঠী ও অনুসারী। নিবেদিতার মা অমিয়াবালা চৌধুরীও ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক।
নিবেদিতার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিলো চট্টগ্রামে। ছোটবেলা থেকেই পরিবারে বিপ্লবীদের আসা-যাওয়া দেখেছেন। বিপ্লবী পরিবেশে বড় হতে হতে প্রতিবাদ, সংগ্রাম, আন্দোলন এসবের সাথে যুক্ত হতে থাকেন।
স্কুলে পড়াকালীন অন্যদের সাথে তিনি বিপ্লবীদের সাহায্যের জন্য চাঁদা তুলতেন। এখানে সেখানে গোপন চিঠিপত্র আদান-প্রদান করতেন। প্রয়োজনে বিপ্লবীদের সাহায্য করতে বাড়িতে তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন। এত ছোট বয়সে এসবের সাথে যুক্ত থাকায় তাকে দু’বছরের জন্য চট্টগ্রামের স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে মায়ের পৈত্রিক বাড়িতে এসে নারায়ণগঞ্জ গার্লস স্কুলে ভর্তি হন, আর এখান থেকে ১৯৩৪ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন।
ম্যাট্রিক পাশের পর নিবেদিতাকে কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি করানো হয়। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় বেথুন কলেজে পড়ার সময় তিনি সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন। সংগঠনের ডাকে ধর্মঘট সংঘটিত করতে গিয়ে কলেজ থেকে ও তিনি বহিষ্কৃত হন। ফিরতে হয় আবার তাকে চট্টগ্রামে। ১৯৩৮ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর এক বছর অসুস্থতার জন্যে পরীক্ষা দিতে পারেননি নিবেদিতা। অতঃপর ১৯৪১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সান্নিধ্য লাভ করেন, যিনি পরবর্তী জীবনে তাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছেন।
নিবেদিতা নাগ ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে ঢাকা জেলা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবাধীন নারী সংগঠনে কাজ করতে গিয়ে তিনি সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছেন আশালতা সেন, লীলা রায়, মণিকুন্তলা সেন ও সুফিয়া কামালের মতো বরেণ্য নেত্রীদের। পার্টির কাজে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন যুঁইফুল রায়, অনিমা সিংহ, কনক মুখোপাধ্যায়, নিরুপমা গুপ্ত, অমিয়া দত্ত, হেলেনা বসু, নীলিমা বসু, শান্তি দত্ত, ডলি বসু, পঙ্কজ আচার্য প্রমুখ কমিউনিস্ট নেত্রীদের।
শিক্ষকতা পেশা দিয়ে শুরু হওয়া নিবেদিতা নাগের কর্মজীবন কেটেছে ঢাকা ও কলকাতায়। অবিভক্ত বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঢাকা জেলা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৪২ সাল থেকে নিবেদিতা নাগ কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৩ সাল থেকে কমিউনিস্ট পার্টির নিয়মিত সদস্য হন। ১৯৪৮ সালের ২৩ জানুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষার দাবি নাকচ হয়ে গেলে বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন- যেখানে অংশ নেন নাদেরা বেগম, নিবেদিতা নাগ, লিলি খান, লায়লা সামাদ এবং বরিশালের মনোরমা বসু প্রমুখ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওপার বাংলাতেই থেকে গিয়েছিলেন নিবেদিতা। তিনি এ দেশের নারী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৯৫৯ সালে নিবেদিতা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে সোভিয়েত ইউনিয়নে যান, সেখানে বিভিন্ন সমাবেশে ভাষণ দেন।
‘কর্মজীবনে পার্টি তাকে কিছুই দেবে না, বরং পার্টিকেই দিতে হবে। এটা ভেবে নিবেদিতা নাগ কমিউন জীবন থেকে বেরিয়ে এসে স্কুলে চাকরি নেন। সংসার তো চালাতে হবে। ১৯৪৭ সালে নারায়ণগঞ্জে তোলারাম কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষর দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০০ সালে তোলারাম কলেজ তাকে এক নাগরিক সংবর্ধনা দেয়। এ সংবর্ধনা সভায় তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করেন।’ ( তথ্যসূত্র: অধ্যাপক পারভীন লাভলী, বই ‘ভাষা আন্দোলনে নারী’, পৃ. ১২৬)
ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ৪০ জন প্রতিনিধি নিয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিতে নারীদের মধ্যে নাদেরা বেগম ও লিলি খান অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সংগ্রাম কমিটির লিফলেট বিতরণ, নারী জমায়েত, প্রণোদনা দান ইত্যাদি কাজে কামরুন্নাহার লাইলী, হামিদা খাতুন, নূরজাহান মুরশিদ, আফসারী খানম, নিবেদিতা নাগ, রানু মুখার্জি, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, রওশন হক প্রমুখ নেতা-কর্মী তার সাথে থেকে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ভাষা আন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধে অবদান সম্পর্কে নিবেদিতা নাগকে নিয়ে ফাতেমা জোহরা লিখেন, ‘নিবেদিতা নাগ ১৯৪৯ সালে জেলে গিয়েছেন, পার্টির নির্দেশে বন্দি নির্যাতনের প্রতিবাদে কারাগারের ভেতর অনশন করতে গিয়ে নিজেও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তারপরও কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হননি। এরপর সন্তানসম্ভবা অবস্থাতেই জড়িয়ে পড়েন পঞ্চাশের ভাষা আন্দোলনে। অনাহারে, অপুষ্টিতে সন্তানের যত্ন নিতে পারেননি, তবু সরে আসেননি আন্দোলনের পথ থেকে। পাকিস্তানি পুলিশের বুটের আঘাত সহ্য করেছেন, নাম বদলে বোরখা পরে সীমান্ত পেরিয়ে এ পারে চলে এসেছেন। পুলিশের ভয়ে দিনের পর দিন কেটেছে গা ঢাকা দিয়ে। শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন তার অনুজপ্রতিম সহযোদ্ধা। ভাষা আন্দোলনের সময় একই কমিউনে ছিলেন তারা। ভারতে অবস্থানের কারণে যদিও তিনি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি; তারপরেও মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় তার বাড়ি ছিল বাংলাদেশের বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম আশ্রয় ...।’
১৯৪৮ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণিক সদস্য হিসেবে নিবেদিতা নাগ যুক্ত ছিলেন। গোপন পোস্টার হাতে লিখে স্টেনসিল কেটে সাইক্লোস্টাইলে ইশতেহার ছেপে বিলি করেছেন। রাতের অন্ধকারে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়েছেন, দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রমে শরীর বার বার অসুস্থ্য হলেও কাজ বন্ধ করেননি।
নিবেদিতা নাগ ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৪৩ সালের ১৭ মে পরিবারের অমতে কমরেড নেপাল নাগকে বিয়ে করেন। নেপাল নাগ জন্মেছিলেন ঢাকার তেজগাঁও-এ। তার ভালো নাম শৈলেশচন্দ্র হলেও নেপাল নামেই পরিচিত ছিলেন। অল্প বয়স থেকেই স্বদেশী ভাবাপন্ন ছিলেন। পরিবারের অমতে বিয়ে করায় শুরু হয় বিভিন্ন সমস্যা, পরে স্থির করেন বাকি জীবন পার্টির কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। আর পরিবারের বাইরে থাকলে কেউ তাদের কাজে বাধা দিতে পারবে না। নেপাল নাগ তখন ঢাকার কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক আন্দোলনের পুরোগামী নেতা হিসেবে পার্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন। তারা দুজন প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানের গোপন কমিউনিস্ট পার্টির এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় সাম্যবাদী আদর্শে যুক্ত থেকে কমিউনিস্ট পার্টি সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত থেকে নিবেদিত ছিলেন শোষিত মানুষের সংগ্রামে।
সন্তানসম্ভবা অবস্থাতেই নিবেদিতা নাগ জড়িয়ে পড়েন পঞ্চাশের ভাষা আন্দোলনে। অনাহারে, অপুষ্টিতে সন্তানের যত্ন নিতে পারেননি, তবু সরে আসেননি আন্দোলনের পথ থেকে। একদিকে পরিবার থেকে আলাদা অন্যদিকে স্বামী-স্ত্রী দু’জন পার্টির সর্বক্ষণিক কর্মী হওয়ার কারণে চরম আর্থিক অনটনে তাদের দিন কেটেছে। নিজেরা যেমন না খেয়ে ছিলেন তেমনি শৈশবে ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খেতে দিতে পারেননি। যার কারণে ছেলে সুজয় ও মেয়ে সুমিতা অপুষ্টি নিয়ে জন্মায়। নেপাল নাগ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট পার্টির চীনের নীতির পক্ষে সমর্থন জানিয়ে কলকাতায় সিপিএমের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৬২ সালে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। চরম অসুস্থ অবস্থায় ১৯৭৮ সালের ৫ অক্টোবর নেপাল নাগকে প্রয়াত হন।
জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে নারী আন্দোলনের নেত্রী ও ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মালেকা বেগম নিবেদিতা নাগের সাক্ষাৎকার নেন। সেখানে মালেকা বেগম উল্লেখ করেন, যদিও ১৯৫৫ সাল থেকে ঢাকা ছেড়ে কলকাতাবাসী হয়েছেন (বাধ্য হয়ে), তবু নিবেদিতা নাগ মনের দিক থেকে আজীবন যুক্ত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউন-বাসী (গোপন পার্টি-জীবনযাপন) থাকাকালীন ‘আত্মগোপনের জীবনযাপনের’ স্মৃতিচারণে। তার বাবার সূত্রে পারিবারিক বৈপ্লবিক নানা স্মৃতিসম্ভারে তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ। সাহসী, কর্মঠ, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত এবং উন্নত জীবনের সফল প্রয়োগে শিক্ষকতার সাফল্যে তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। নারী আন্দোলন ও সাম্যবাদী আন্দোলনে সারা জীবন সাফল্যের সঙ্গে কৃতী মানুষ হওয়ার উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন ঢাকার কারাজীবন। তার লেখা বই, আলোচনা, বিভিন্ন প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় তার বেঁচে থাকা ৯৫ বছরের সুখ-দুঃখ-কৃতিত্ব-দাম্পত্য জীবন-বিপ্লবী জীবন-নারী আন্দোলন-কর্মজীবন-সমাজসেবার স্বর্ণময় কাহিনী। সেসব কাহিনীর সূত্র ধরে নিবেদিতা দিদির সাক্ষাৎকার নিয়েছি কলকাতায় বীরেশগুহ রোডে তার নিজের ২৬ নম্বর বাড়িতে।
ভাষাকন্যা, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও শিক্ষাবিদ নিবেদিতা নাগ লেখালেখি করতেন। কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকায় নিয়মিত তার কলাম ছাপা হত। এ ছাড়া অন্য পত্রিকায়ও লিখতেন তিনি। কলকাতায় চলে আসার পর ১৯৬৫ সালে পাঠভবন স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কাজ করেন তিনি। জীবনসঙ্গী নেপাল নাগ কে নিয়ে ‘নেপাল নাগ স্মৃতিচারণা’ নিবেদিতা নাগ সংকলিত বই লিখেন। কলকাতা ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লি. থেকে বইটি প্রকাশিত হয় জুলাই ১৯৯৬ সালে। ‘ঢাকা থেকে কলকাতা’ নিবেদিতা নাগের লেখা আরেকটি বই। ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট কলকাতা-৫৬-এর আলোচনা চক্র থেকে বইটি প্রকাশিত হয়।
তার লেখালেখি নিয়ে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও নারীনেত্রী মালেকা বেগম লিখেন, তার সংগ্রামমুখর ও কর্মমুখর বিপ্লবী জীবনের কথা লিখেছেন। বাংলাদেশের ঢাকায় (পূর্ববঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে উত্তরণের সময়কালে) তার শিক্ষাজীবন, বিপ্লবী জীবনের কর্মকাণ্ড, পেশাগত শিক্ষকতা, বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেপাল নাগের সঙ্গে পূর্বরাগ-প্রেম ভালোবাসার বিয়ে, বিপ্লবী সংসারজীবন, আত্মগোপনের সময়ে সন্তানসম্ভবা, স্বাস্থ্যহীনতা সত্ত্বেও আসন্ন মাতৃত্বের আনন্দ, নেপাল নাগের অসুস্থতা-সব ছাপিয়ে বিপ্লব-আন্দোলনের স্মৃতি রোমন্থনে তিনি কলম চালিয়ে উপহার দিয়েছেন অনেক তথ্য।
ছেলে সুজয় নাগের রিউম্যাটিক হার্টের অসুখ হওয়ায় নিবেদিতা নাগ ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় চলে যান। এরপর ১৯৫৮ সাল থেকে ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। অন্যদিকে নেপাল নাগ ১৯৬৪ সালে ভাগ হওয়া আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট পার্টির চীনের নীতির পক্ষে সমর্থন জানিয়ে কলকাতায় সিপিএমের রাজনীতিতে যুক্ত হন। কলকাতায় থেকেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যে কাজ করেছেন নাগ দম্পতি। ভাষা আন্দোলনের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন ‘ভাষা সৈনিক’ সম্মাননা।
২০১৩ সালের ৫ মে রবিবার কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক বিপ্লবী নিবেদিতা নাগের মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। শেষ বয়সে তিনি পুত্র সুজয় নাগের সাথে কলকাতার পার্ক সার্কাসের বাড়িতে বসবাস করতেন। কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
রহিমা আক্তার মৌ : কলাম লেখক ও সাহিত্যিক।
আজকালের খবর/আরইউ