রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে মানুষের কাছে নতুন এক আতঙ্কের নাম বেপরোয়া মোটরবাইক চালনা। গত কয়েক বছরে বিশেষ করে অ্যাপসভিত্তিক রাইড সার্ভিস চালু হওয়ার পর থেকে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন মোটরসাইকেল রাস্তায় নামছে। গ্রামে গঞ্জেও অহরহ ব্যক্তিগত বা পেশাদার মোটরসাইকেল চালনা ব্যাপকভাবে চোখে পড়ছে। শহর ও গ্রামে হাজার হাজার মোটর সাইকেলের কারণে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার খবর সংকলন করে বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) ও নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলন। নিসচার হিসাবে, ২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে তিন হাজার ২৩২টি, যার এক হাজার একশ ২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। অন্যদিকে, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২২ সালের প্রথম চারমাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আটশ ৩০ জন নিহত হয়েছে। এ ছাড়া ২০২১ সালে দুই হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে এবং এতে দুই হাজার ২১৪ জন মারা যান, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ।
তা ছাড়া, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সেভ দ্য রোড’-এর তথ্য অনুযায়ী সাম্প্রতিক ঈদযাত্রার ১২ দিনে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ছয়শ ৮১ জনের প্রাণ গেছে অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৫৬ জন প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত দুই হাজার ৭৭ জন। মোটরসাইকেল এককভাবে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে। মোট এক হাজার ছয়শ ১৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৯৬৮ জন আহত এবং ১৯০ জন নিহত হয়েছেন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩৬ লাখ ৫০ হাজার হলেও ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা মাত্র ২৩ লাখ ৫০ হাজার। শুধু ঢাকাতেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল আট লাখের মতো। এর বাইরে একটি বড় অংশের মোটরসাইকেল অনিবন্ধিত। তবে, বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় পাঁচ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি ও সড়কে যুক্ত হয়।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা গবেষকেদের মতে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো মূলত ঘটে বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা ও চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলার কারণে। হেলমেট ব্যবহার না করা ও নিম্নমানের হেলমেটের কারণেও দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালের এক তথ্য বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে যাওয়া প্রায় ৩৫ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। এর মধ্যে রাজধানীর বাইরে থেকে রোগীই সবচেয়ে বেশি আসে। তবে সম্প্রতি রাইড শেয়ারিংয়ে থাকা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত মানুষ আসার সংখ্যাও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
আসলে মোটর সাইকেল চালকরা প্রতিনিয়ত ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করছে। যার ফলে সড়কে ঘটছে নানা ধরনের মারাত্মক দুর্ঘটনা। শহরে সড়কের উল্টো দিক দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা সর্বাধিক। তাই সবার আগে জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। ফুটপাতে মোটর সাইকেল চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করা দরকার, নির্ধারিত গতিসীমার অতিরিক্ত না চালানো, ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে রাস্তার মোড় পার হওয়া, জোরে হর্ন না বাজানো, সর্বোপরি ট্রাফিক আইন মেনে চলার জন্য জনমত গঠন করা খুবই জরুরি। সেই সঙ্গে জেব্রা ক্রসিং ও ফুট ওভারব্রিজ ছাড়া রাস্তা পারাপারে পথচারীদের নিরুৎসাহিত করা দরকার।
রাজধানীর যানবাহনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আইন ভঙ্গ করছে মোটরসাইকেল। ট্রাফিক পুলিশের মতে, মোটরসাইকেল চালকরা বেশিরভাগ সময় আইন মানতে চান না। সুযোগ পেলেই তারা সিগন্যাল অমান্য করেন। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, রাস্তার কোনো এক অংশে গাড়ি চলাচল বন্ধের জন্য কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যাল দিয়েছেন। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, সিগন্যালের শুরুতে কয়েকটি মোটরসাইকেল জোরে টান দিয়ে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় ট্রাফিক পুলিশ এ ধরনের ক্ষেত্রে সিগন্যাল অমান্যের মামলা দেয়। কিন্তু মোটরসাইকেল সংখ্যা বেশি হওয়ায় তাদেরও হিমশিম খেতে হয়। তবে রাজধানীর কিছুকিছু জায়গায় মোটরসাইকেল চালকদের আইন মানাতে সিগন্যালের সময় রশি ব্যবহার করতেও দেখা যায়।
শুধু সিগন্যালই নয় জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করে পথচারীদের রাস্তা পারাপারের নিয়ম থাকলেও মোটরসাইকেল চালকরা ট্রাফিক সিগন্যালের সময় জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর মোটরসাইকেল থামায়, যেন সবুজ সংকেত দিলে আগেই রাস্তার মোড় পার হতে পারে। এতে পথচারীদের রাস্তা পার হতে পোহাতে হয় বিড়ম্বনা। সামনে থাকা যানবাহনকে ওভারটেকিং করার সুযোগ না থাকলেও মোটরসাইকেল যাওয়ার জায়গা করে দেওয়ার জন্য অযথা হর্ন বাজিয়ে সংকেত দেওয়ার যে মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে, তা ভয়াবহ শব্দদূষণ ঘটাচ্ছে।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পর মোটর সাইকেল চালক ও আরোহীদের হেলমেট পরার বিষয়ে অনেকের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরও অনেকেই আইন মানছেন না। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরসাইকেল চালক হেলমেট পরিধান করলে দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার আশঙ্কা ৪০ শতাংশ হ্রাস পায় এবং মারাত্মক আহত হওয়ার আশঙ্কা ২৫ থেকে ৭৫ শতাংশ হ্রাস পায়। এ কারণে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের নিজেদের জীবন বাঁচাতেই হেলমেট পরিধান আবশ্যক। অনেক সময় চালকরা মোটরসাইকেল চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলেন। এমন কারণেও মনোসংযোগের বিঘ্ন ঘটে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তা ছাড়া, দেশের বেশিরভাগ মোটরসাইকেল চালকের মধ্যে আইন ভাঙ্গার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। রাস্তাঘাটে মোটর সাইকেল চালকদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষমতার দাপট দেখানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ট্রাফিক পুলিশের তথ্যমতে, সারা দিনে যদি ২০টি মোটরসাইকেলকে সিগন্যাল ভঙ্গ বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের জন্য থামানো হয়, তাহলে কমপক্ষে ১০ জন বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা নেতাদের ফোন ধরিয়ে দেন। তখন বাধ্য হয়েই তাদের ছেড়ে দিতে হয় এবং এ ছাড়া তাদের কোনো উপায় থাকে না। শুধু ফোনেই ক্ষমতার দাপট শেষ নয়। মোটর সাইকেলের সামনে-পেছনে পুলিশ, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, জরুরি সার্ভিস, বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামও দেখা যায়। তাদের ক্ষমতার দাপটে পুলিশের আইন ও নিয়ম তুচ্ছ হয়ে যায়। তখন ট্রাফিক পুলিশকে অসহায় ভূমিকা পালন করতে হয়।
একটা সময় বাইক ছিল তরুণদের শখের জিনিস। কিন্তু বর্তমানে স্বল্প সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাতায়াত করা যায় বলে রাজধানীতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অ্যাপসভিত্তিক মোটরসাইকেল সেবা। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিনিয়ত এ সেবা গ্রহণ করছেন। বাইক চালিয়ে সহজেই অর্থ উপার্জন করা যায় বলে অনেক যুবকই পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন রাইড সার্ভিস দিচ্ছেন। কিন্তু বর্তমানে অনেকেই শুধু রাইড শেয়ার দিয়ে টাকা কামানো ধান্দায়, কোনোমতে একটা পুরনো নিম্নমানের বাইক নিয়েই অ্যাপসভিত্তিক মোটরসাইকেল সেবায় রেজিস্ট্রেশন করেই রাস্তায় নেমে পড়ছেন। অনেককেই মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরবাইক নিয়ে রাইড শেয়ার দিচ্ছেন। যাত্রীদের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ চালকদের হেলমেট না পড়া। অধিকাংশ বাইক চালকদের হেলমেট পরিত্যক্ত পর্যায়ের বা নামকাওয়াস্তের। ফলে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও ঝুঁকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০০৬ সালের একটি গবেষণা বলছে, ভালো মানের একটি হেলমেট পরলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হওয়ার ঝুঁকি কমে ৭০ শতাংশ। আর মৃত্যুঝুঁকি কমে ৪০ শতাংশ।
সারা দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সড়কে বাড়ছে বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি। বেপরোয়া মোটরসাইকেলগুলো অধিকাংশ সময় ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা করছে না। সিগন্যাল উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অবাধে ফুটপাতেও চলাচল করছে। যানজটের মধ্যে সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা না করে চালকরা দলবেঁধে ফুটপাত দিয়ে অহরহ চলাচল করছেন। রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে অহরহ ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল উঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। ফলে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন পথচারী। পথচারীদের কেউ কেউ বিরক্তি বা প্রতিবাদ করলে তাকে হেনস্তাও হতে দেখা যায়।
ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে উচ্চ আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। উক্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কোনো অবস্থায়ই হাঁটার পথে মোটরবাইক চালানো যাবে না। এ ছাড়া ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালালে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড এবং ৩৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-তে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, আইনগুলো বাস্তবায়ন হলে ফুটপাতে মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য অনেকাংশেই কমে যাবে।
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) মতে, সড়ক নিরাপত্তার জন্য মোটরসাইকেল বড় হুমকি। মানুষ দ্রুত তার গন্তব্যে যেতে চায়। এ কারণেই রাজধানীর গতিহীন সড়কে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছে। যানজট পরিস্থিতির উন্নতি হলে মোটরসাইকেল নিয়ে এত দুর্ভাবনার কারণ হতো না। মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে আইন মানার প্রবণতা তুলনামূলক কম। তারা সুযোগ পেলেই আইন ভেঙ্গে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনার জন্য, জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ, সড়ক ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারকারী সবাইকে সংযুক্ত করে দেশব্যাপী নিরাপদ সড়কের জন্য ক্যাম্পেইন চালানো দরকার। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্পিড রাডার বসানোর পাশাপাশি নির্দিষ্ট সীমার তুলনায় অধিক গতিতে মোটরসাইকেলসহ সব যানবাহন চালান নিরুৎসাহিত করা জরুরি। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে বিআরটিএর কর্মকর্তাদের আরো দায়িত্বশীল ও সতর্ক থাকতে হবে, যেন অসদুপায় অবলম্বন করে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া না যায়। ট্রাফিক পুলিশকে আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে আরো কঠোর ও দায়িত্বশীল হতে হবে। এক্ষেত্রে শ্রেীন ভেদাভেদ ভুলে সকলকে কঠোর আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ