মহান কবি হোমার তার ইলিয়াডে যুদ্ধ সম্পর্কে বলেছেন- ‘কোনো চিহ্ন ছাড়াই তার তলোয়ারটি/আঁকতে থাকে একজন সাহসী যোদ্ধা/আর কোনো শকুন প্রশ্ন করে না/আপনার দেশ কোথায়?’
প্রথম কবি এনহেদুয়ান্না, যিনি জন্মগ্রহণ করেছেন প্রাচীন সুমেরীয় শহর রাজ্যে এবং সেখানেই বেড়ে উঠেছেন। সেটি সম্ভবত আজ থেকে চারহাজারেরও ঊর্ধ্বে সময়। তিনি তার কবিতায় যুদ্ধ সম্পর্কে বলেছেন- ‘তুমি, যেনো রক্তের একটি পাহাড়ি ঝর্ণা/ঘৃণা, লোভ আর শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার তোমার মৃত্যু।’
আবার আরেকটি কবিতায় আমরা পাই- একটি পাতার পরিবার বসে আছে বসন্তের কাছে/আহত চোখের জলের জমিতে/এবং জলের কাছে শিখছে আগুনের অভিধান।/...আমার পরিবার আমার অপেক্ষা করেনি/তারা চলে গেছে/না আছে আগুন, না আছে কোনো আগুনের চিহ্ন।’ কবিতাটি সমকালীন বহুল আলোচিত সিরিয়ান কবি আদুনিসের। আরববিশ্বের ওপর চাপিয়ে দেওয়া পশ্চিমাদের যুদ্ধ, আর মৃত্যুর বিভিষীকা নিয়ে তার কবিতা আবহমান অনেকেরই মনের জ্বালার কারণ। তাই প্রতিবার নোবেল কমিটির বাছাইপর্বে গিয়েও, আলগোছে বাদ পড়ে যান এই বিদ্রোহী। তবু কলমের আগুন তিনি নির্বাপিত হতে দেন না। আগুনের গাছ থেকে অগুনতি ফল- মরণ বিষের ফল তিনি ছড়িয়ে দিচ্ছেন পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী সেনাদের বুকের ভেতর। এই যে দুর্নিবার প্রেরণা, যুদ্ধময় বিশ্বের বিপরীতে শান্তির কপোত উড়ানোর দায়, তা যুগে যুগে মনীষীরাই করে গেছেন। শিল্প-সাহিত্য-দর্শন, এমনকি প্রকৃত বিজ্ঞানও মূলত যুদ্ধবন্ধেরই গূঢ় তত্ত্ব-সত্য। তবু আমরা মানুষ বুঝি না। আপন প্রয়োজনে কিংবা কখনো বা আক্রমনাত্মক ভঙ্গিতে জড়িয়ে পড়ি যুদ্ধে। এ যুদ্ধ থেকে আমাদের মুক্তি নেই। যেনো যুদ্ধা হিসেবেই প্রতিটি মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমের স্বাধীনতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে প্রাণ গেছে ত্রিশ লাখ মানুষের। সম্ভ্রম হারিয়েছেন দু লাখের বেশি মা-বোনের। এ যুদ্ধকে স্মৃতিবন্ধি করতে বাঙালি কবিরা তাদের কলমে লিখে গেছেন রক্তের অক্ষর। সেসব কবিতার ভেতর থেকে যুদ্ধবিষয়ক মৌলহৃদয়ের গুমরানো আর্তনাদ আমাদের মনোলোকে বড় একটি ধাক্কা দেয়। আমরা দেখতে পাই, বিভীষিকাময় সেই ১৯৭১, স্বাধীনতার সংগ্রাম, পাকিস্তানি বর্বরদের অব্যাখ্যেয় অত্যাচার এবং সবিশেষ বাঙালির প্রাণপণ লড়াইয়ের মাধ্যমে বিজয় অর্জন। এ বিজয়ের ভেতর থেকে যে চিত্রটি আমাদের মধ্যে ভেসে উঠে তার একটি রূপছবি দেখা যায় সৈয়দ আলী আহসানের ‘ফেরা’ কবিতায়। তিনি লেখেন- পথহীন ঘন অরণ্যের মধ্যে হেঁটেছি/এবং সুদীর্ঘ আবর্তিত পথে-/সুদীর্ঘ চরণচিহ্নহীন পথে।/...গাছ থেকে আলো সরে গিয়েছিলো/এবং অনেক মৃত মানুষ ছিলো নদীতে/এবং বনভূমিতে/এবং আরও অনেক মানুষ শুধু হাঁটছিল/অনবরত হাঁটছিল।’
সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’-এ আমরা দেখতে পাই ‘মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক সমকালীন বাস্তবতা এবং ব্রাত্যজনের অমিত তেজের সরল সত্যের অকৃত্রিম ও শৈল্পিক প্রকাশ।’ পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃক এ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর বর্বরোচিত হামলা, হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন ধর্ষণের প্রভুতচিত্রকে ইঙ্গিত করে এই কাব্যনাটকটি। আবার বিখ্যাত মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর ইন যশোর রোড’ কবিতায় আমরা পাই- ‘সেপ্টেম্বর, হায় একাত্তর, ঘর ভেঙে গেছে যুদ্ধের ঝড়ে,/যশোর রোডের দুধারে মানুষ এত এত লোক শুধু কেনো মরে?/শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শিশু মরে গেলো,/যশোর রোডের যুদ্ধক্ষেত্রে ছেঁড়া সংসার সব এলামেলো।’ অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে এসেছিলেন ভারতের কলকাতায়। সেখানে তার বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে উঠেন। তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক দেশহারা মানুষ শরণার্থী হিসেবে মানবেতর জীবন যাপন করছে পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে। তাদের দুঃখ-দুর্দশা দেখেই কবি এ কবিতাটি লেখেন। পরে ববডিলান সেটিকে গানে রূপায়িত করে কনসার্ট ফর বাংলাদেশে পরিবেশন করেন। যুদ্ধকালীন সময়ের প্রথমদিকের একটি কল্পচিত্র দেখা যায় কবি নির্মলেন্দু গুনের কবিতায়। তিনি লিখেনÑ কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে এই মাছে ছুটে এসেছিলো/কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক, লাঙল জোয়াল কাঁধে/ এসেছিলো ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে/এসেছিলো প্রদীপ্ত যুবক...।’
কবি আবুল হাসানের ‘উচ্চারণগুলি শোকের’ কবিতা থেকেও কয়েকছত্র পাঠ করা যায় এ প্রসঙ্গে- ‘লক্ষ্মী বউটিকে আমি আজ আর কোথাও দেখি না,/হাঁটি হাঁটি শিশুটিকে কোথাও দেখি না;/কতগুলি রাজহাঁস দেখি,/নরম শরীর ভরা রাজহাঁস দেখি/কতগুলি মুখস্থ মানুষ দেখি, বউটিকে কোথাও দেখি না/শিশুটিকে কোথাও দেখি না।/...তবে কি বউটি রাজহাঁস/তবে কি শিশুটি আজ সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ?’
স্কটিশ যুদ্ধের কবি চার্লস হ্যামিল্টন সোরলি মাত্র বিশ বছর বয়েছে লুসের যুদ্ধে মারা যান। রবার্ট গ্রেভস তার যুদ্ধস্মৃতিকথা ‘গুডবাই টু অল দ্যাট’-এ লেখেন- ‘লুসের যুদ্ধে নিহত তিনজন গুরুত্বপূর্ণ কবির মধ্যে একজন চার্লস সোরলি।’ সোরলি তার ‘যখন আপনি লাখ লাখ মুখহীন মৃতকে দেখেন’ কবিতায় বলেন- যখন তুমি লাখো ফ্যাকাশে মুখের মৃতকে দেখতে পাও/ব্যাটেলিয়ানরা তোমার স্বপ্নকে অতিক্রম করে চলে যায়/সাধারণ পুরুষদের মতো নরম কথা তোমাকে মানায় না/...অশ্রুও নয়। তাদের চোখ অন্ধ/তোমার অশ্রুপ্রবাহ দেখতে পায় না/...মৃত হওয়া সহজ।’ আলিশা মেকলসের ‘যোদ্ধার কন্যা’ কবিতায় দেখা যায় আরেক বাস্তবতা। বাৎসল্য প্রেম এবং পিতা থেকে দূরে থাকা এক কন্যার আর্তনাদ এখানে ফুটে উঠেছে গভীর মমতায়। আবার যুদ্ধের সপক্ষের যে বাস্তবতা, তার কথাও অস্বীকার করার চেষ্টা করেননি আলিশা। তাই একদিকে যেমন মমতার টান, আরেকদিকে তেমনি বাঁধা পড়ে যুদ্ধের দায়িত্ববোধ। তাই কবি লিখেন- ‘আমি জানি প্রতিদিন তুমি আমাকে ভাবছো/এবং বাড়িতে আসতে চাও;/আমি জানি, প্রতিদিন তুমি আমার জন্য যুদ্ধ করো/যেনো আমি নিরাপদে বিচরণ করতে পারি।’ স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে পাবলো নেরুদার বিখ্যাত কবিতা ‘আমি কয়েকটি জিনিস ব্যাখ্যা করছি’তে তিনি বলেন- রাস্তায় শিশুদের রক্ত/সহজভাবে শিশুদের রক্তের মতো দৌড়ে যায়।’ কবিতার শেষে এসে নেরুদা মানুষকে তার যুদ্ধের সামগ্রিক বিধ্বংসী ফলাফলটি দেখার জন্য অনুরোধ করেন। আবার আলফ্রেড টেনিসন তার ‘লাইট বিগ্রেডের দায়িত্ব’ শীর্ষক কবিতায় লেখেন- ‘তাদের ডানে কামান/তাদের বাম দিকে কামান/তাদের পেছনে কামান/মেঘ এবং বজ্রপাত;/গুলি এবং শেলের ঝড় উঠছে,/যখন ঘোড়া এবং বীরগণ পড়ে গেলো/যারা এতো ভালো যুদ্ধ করেছে/মৃত্যুর চোয়াল ভেদ করে তারা ফিরে এলো।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য কবিতা। কিছু কবিতা উতরে গেছে সময়ের মাপকাঠি, কিছু কবিতা ছুঁয়ে দিয়েছে বিশ্বপরিসর। আবার এসব কবিতা থেকে অনেক কবিতা একান্তই বাঙালিদের দুঃখ দুর্দশার দলিল। মূলত ঈঙ্গিতময় সময়ের ছবি, যুদ্ধকালীন বাঙালির মানসিক ভর ও প্রক্ষেপ, -এসব ফুটে উঠেছে সেসব কবিতায়। এ প্রসঙ্গে শামসুর রাহমানের স্বাধীনতা তুমি, বন্দি শিবির থেকে, তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য। সৈয়দ শামসুল হকের প্রায় প্রতিটি কবিতায় কোনো না কোনো তাৎপর্যে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের আভাস, ভাষা। তার কবিতাগুলোর মধ্যে অবরুদ্ধ শহরে চতুর্থ মাস, গেরিলা, একদা এক দেশ ছিলো, মার্চের গান, অনিবার্য মিল খুঁজে পাই, মুক্তি ও স্বাধীনতার সাতই মার্চসহ আরো আরো অসংখ্য কবিতায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ। জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজের একটি পতাকা পেলে, অস্ত্র সমর্পণ; হুমায়ুন আজাদের এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়; রফিক আজাদের চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া; আসাদ চৌধুরীর রিপোর্ট ১৯৭১, শহীদদের প্রতি প্রাণিধানযোগ্য। চিরবিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলামের উত্তরসূরী, উত্তরবিদ্রোহী কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ কবিতায় পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় দৃশ্যকল্প। তিনি লিখেন, ‘তাঁর চোখ বাঁধা হলো।/বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করলো তার মুখ।/থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লালা-রক্তে একাকার হলো,/জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত ঝরে পড়লো কংক্রিটে।’ তাঁর বাতাসে লাশের গন্ধ সাড়া জাগানো মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। কবি শহীদ কাদরীর রাষ্ট্রপতি কি মেনে নেবেন; মোহাম্মদ রফিকের অন্য জন্মে, আমিও কি?; মহাদেব সাহার আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি; বুদ্ধদেব বসুর মুক্তিযুদ্ধের কবিতা; পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের খবর; সিকান্দার আবু জাফরের বাংলা ছাড়ো; মাসুক চৌধুরীর জননী; ফরিদ আহমদ দুলালের বধ্যভূমি; মিনার মনসুরের মুক্তি; তারিক সুজাতের শূন্যদৃষ্টি জননীর চোখ এবং আরো অসংখ্য কবিতা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিনিধিত্ব করে। স্বাধীনতা তো মানুষের মৌলিক অধিকার, জন্মগত উত্তরাধিকার। তবু মানুষের স্বাধীনতা হরণ হয় মানুষেরই হাতে। যুদ্ধবাজ কিছু বিশ্বসন্ত্রাসের হাতে, বন্দি হয়ে পড়ে তাবৎ সৌন্দর্য। সে সৌন্দর্যের পুনরুদ্ধারের জন্য, কবিরা স্রোতের প্রতিকূলে রেখে যান কালের ইঙ্গিত। সভ্যতা থেকে সভ্যতাব্যাপী সেসব কবিতা গণমানুষের মুক্তির বার্তা বয়ে নিয়ে যায়।
আজকালের খবর/আরইউ