আগের মতো যৌথ পরিবার ব্যবস্থা আজকাল আর নেই। নানা বাস্তবতায় এখন একক পরিবারের আধিপত্য চোখে পড়ছে শহরের সারি সারি বহুতলা ভবনের ফ্লাট আর এ্যাপার্টমেন্টকেন্দ্রিক একক পরিবারগুলো এক সময় বড় বড় যৌথ পরিবারেরই অংশ ছিল। নানা প্রয়োজনে সময়ের দাবি পূরণ করতে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়ে তুললেও এখানে সংকটের শেষ নেই। একক পরিবারের বড় একটি সমস্যা হলো এখানে পারিবারিক সম্পর্কগুলো সঠিকভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে না। সম্পর্কে ভাঙন ধরে এখানে খুব সহজেই। পারস্পরিক সমঝোতা, বিশ্বাস ও আস্থার অনেক ঘাটতি থাকে। সম্পর্কের নানা টানাপোড়ন চলতে থাকে সারা সময়েই। আর এই সম্পর্কের নানা টানাপোড়নের আর জটিলতা শিকার হয় পরিবারের সন্তানেরা। তাদের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় চরমভাবে। তারা উদারভাবে কোনোকিছু চিন্তা করতে পারে না। সবসময় একটা তীব্র মানসিক চাপে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। যার প্রকাশ আমরা এখন দেখছি আমাদের চারপাশে।
নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনাময় ছেলেমেয়েরা আজকাল হতাশা, বিষণ্নতা, আত্মকেন্দ্রিকতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে সিজেফ্রেনিয়ার মতো মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। সামাজিক নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। যৌন অপরাধ এবং বিকৃতির দিকে ঝুঁকছে। এ সবের কোনোটাই আমাদের কাম্য নয়। নানা ধরনের নিরাপত্তাহীনতা ইমোশনাল ডিপ্রাইভেশন ও আইডেন্টি ক্রাইসিসে ভুগতে ভুগতে আমাদের নতুন প্রজন্ম সম্ভাবনার বিপরীত পথে হাঁটছে। শুধু তাই নয়, একক পরিবারে যে কোনো একজন সদস্যের অনুপস্থিতি তৈরি করছে নানা সংকট। কারণ এখানে সবদিক থেকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো কেউ থাকছে না। একক পরিবারে স্থান হচ্ছে না বৃদ্ধ বাবা-মায়ের। তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে গ্রামের বাড়িতে নিভৃত নির্জন পরিবেশে কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে তারা ধুঁকে ধুঁকে চরম অবহেলা আর অযত্নে জীবনের শেষ সময়গুলো কোনোভাবে পার করছেন। এর ফলে নাতি-নাতনিরা দাদা-দাদি, নানা-নানির স্নেহে স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চরমভাবে। তারা দাদা-দাদীর, নানা-নানির কাছ থেকে অতীত দিনের নানা অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির কথা জানতে পারছে না। তারা জীবন ও জগত সম্পর্কে তেমন কেন জ্ঞান বা ধারণা লাভ করতে পারছে না প্রবীণ অভিজ্ঞজনের অনুপস্থিতিতে। অনেক একক পরিবারের স্ত্রীর আপত্তি কিংবা অনাগ্রহের কারণে বৃদ্ধ বাবা-মাকে ঠাঁই দিতে না পেরে আক্ষেপে দুঃখে-ক্ষোভে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে পুত্রহৃদয়। এভাবেই নানা টানাপোড়নে আর সংকটে বার বার ধাক্কা খাচ্ছে একক পরিবারগুলো।
আসলেই পরিবার একজন মানুষকে ধাপে ধাপে তৈরি করে। একটা মানুষকে ভালো কিংবা মন্দভাবে গড়ে উঠতে পরিবারই বড় ভূমিকা পালন করে। একজন মানুষ সেভাবেই বেড়ে উঠবে পরিবার তাকে যেভাবে গড়ে তুলবে। প্রকৃতপক্ষে শিশুর সঠিক মানসিক বিকাশের জন্য পরিবারের সান্নিধ্য খুবই প্রয়োজনীয়। স্নেহ, মায়া, যত্ন এবং প্রয়োজনে শাসন তো প্রথমে পরিবার থেকে আসে। মা-বাবার আদর, সোহাগ এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
আজ যৌথ পরিবারের ধারণা ভেঙে একক পরিবার তৈরি হচ্ছে। একক পরিবার গঠনের পক্ষে যুক্তি হচ্ছেÑযৌথ পরিবারে ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকে না, পরিবারের পারিবারিক সম্পর্কগুলো সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারে না। সম্পর্কে ভাঙন ধরে একক পরিবারে খুব সহজেই। আজকাল সামাজিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের অধঃপতনের জন্য একক পরিবারের নানা সংকটই দায়ী। এ জন্য প্রায়ই ঘটছে নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। মানসিক দ্বন্দ্বের কারণে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হাতাশা তীব্র হচ্ছে। এর ফলে নিরাপত্তাহীনতা, ইমোশনাল ডিপ্রাইভেশন ও আইডেন্টি ক্রাইসিসও বাড়ছে। এ ধরনের বিপর্যয় ঠেকাতে পরিবারে বয়োবৃদ্ধ সদস্যরা কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। কারণ এই একক পরিবারগুলোতে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ঠাঁই হচ্ছে না, তাদের গ্রামের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। অনাদরে, অযত্নে, অবহেলায় অনেকটা অসহায় মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। কারও মা-বাবার স্থান হচ্ছে দূরে নিভৃত এলাকার বৃদ্ধাশ্রমে। ফলে নাতি-নাতনির, দাদা-দাদির স্নেহের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়ে ভেতরে ভেতরে কেঁদে মরছে। তারা জীবন ও জগত সম্পর্কে কোনো ধরনের গভীর জ্ঞান লাভ করতে পারছে না অভিজ্ঞহননের অনুপস্থিতিতে। প্রায়ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্ত্রীর আপত্তি কিংবা অনাগ্রহের কারণে বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিজের সংসারে ঠাঁই দিতে পারে না অনেক মানুষ। সময়ের প্রেক্ষিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের নানা টানাপোড়ন ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এর কারণ কমিউনিকেশন গ্যাপ, আর্থিক ও পারিবারিক নানা বিষয়। আধুনিক ও সচেতন মানুষ হিসেবে সন্তানকেই এক্ষেত্রে পিতা-মাতার সঙ্গে সম্পর্ক সুন্দর ও স্বাভাবিক করতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
সারাদিনের কর্মক্লান্তি শেষে আমরা আমাদের যে যার পরিবারে ফিরে এসে প্রশান্তি আর স্বস্থির বদলে চরম অশান্তি এবং টেনশনের যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে মরছি। সবাই এখন পরিবারের গন্ডিকে ছোট করে ফেলতে চাইছে, একা একা থাকতে চাইছে। নিজের সুখ নিজের আনন্দই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে সবার চিন্তা-ভাবনায়। ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধে যেতে পারছে না বেশিরভাগ মানুষ। এখন আমাদের নাগরিক জীবনধারা প্রভাবিত হচ্ছে সিনেমা, নাটক, টিভি চ্যানেলের দ্বারা। এক সময়ে বড়রা বাড়িতে ঢুকলে ছোটরা সংযত হয়ে যেত, পড়াশোনায় মন দিত। বাড়িতে বড় মুরব্বি গোছের কেউ এলে ছোটরা পারতপক্ষে সামনে যেত না। এখন আগের সেই মূল্যবোধ আর অটুট নেই। আজকাল ‘ফ্রিডম’ আর ‘ফ্রিনেস’ এতোটাই আক্রান্ত করেছে যে পরিবার কেউ কাউকে সহজে মানতে চাইছে না। খুব ছোট বয়স থেকেই সব কিছুতে তর্ক করা কিংবা দুর্বিণীতিভাবে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার প্রবণতাই ফ্রিডমের প্রকাশ হয়ে উঠেছে। এখন সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবারা আগের তুলনায় বেশি ফ্রি। কিন্তু এই ফ্রি হওয়ার সুযোগটা মঙ্গলজনকভাবে কাজে না লাগিয়ে খারাপ কাজে লাগাচ্ছে এখনকার অনেক ছেলেমেয়ে। তারা বাবা-মাকে তেমন পাত্তা দিতে চায় না। বাড়ির বাইরে থাকছে রাত হয়ে যাবার পরেও। এ বিষয়ে কঠিনভাবে শাসন বারণও করা যাচ্ছে না। তারা নানা রকমের দোহাই দিয়ে বাবা-মায়ের মুখ বন্ধ করে দিচ্ছে। আজকাল ছেলেমেয়েরা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বাসায় বাবা-মাকে জানিয়ে তাদের মতামত নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করছে না। তারা নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
এক সময় সামাজিক অটুট বন্ধনে যৌথ পরিবার ছিল নিউক্লিয়াসের মতো। সভ্যতার বিকাশে ক্রমেই যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে একক পরিবারে রূপান্তরিত হচ্ছে। এখন যে একক পরিবারের প্রাধান্য সেই পরিবারের সদস্যরা জীবনের সঠিক মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে না। এখনকার নাগরিক জীবনে ব্যস্ততা যান্ত্রিক গ্রাস করেছে সবাইকে। আজকাল বাবা-মা’রা তাদের সন্তানদের যথাযথভাবে সময় দিতে পারছেন না। পেশাগত নানা ব্যস্ততায় অস্থির সময় কাটছে সবার। সন্তান তার বাবা-মাকে কাছে পাচ্ছে খুব কম। আমরা যারা এখন বাবা কিংবা মা, একবার ভেবে দেখুন, আমরা আমাদের সন্তানদের কতটা দেখভাল করতে পারছি আগের দিনের বাবামায়েদের তুলনায়? আমাদের বাবা-মায়েরাও কম ব্যস্ত মানুষ ছিলেন না। তারা কর্মজীবনের অনেক অনেক ব্যস্ততা, ঘর গৃহস্থালি কাজের নিত্য ঝামেলার পরেও আমাদের খাওয়া দাওয়া, লেখাপড়া জীবন গঠন, সঠিকভাবে যোগ্যভাবে মানুষ হয়ে ওঠা ইত্যাদি বিষয়ে সার্বক্ষণিক মনোযোগ রেখেছেন, যেখানে যা করা দরকার তাই করেছেন। যেমনভাবে শাসন করেছেন তেমনিভাবে আদর স্নেহও করেছেন। আমাদের চাহিদা, সাধ-আহ্লাদ পূরণের ক্ষেত্রে তাদের বিন্দুমাত্র অবহেলা কিংবা অমনোযোগ ছিল না। আজকের দিনে বাবা-মা’রা তাদের সন্তানদের সঠিকভাবে সময় দিচ্ছে না বলে সময়ের ধারাবাহিকতায় পারিবারিক অপশাসনে সন্তান হচ্ছে বিপথগামী, সন্ত্রাসী, মাদকাসক্ত, উচ্ছৃঙ্খল, ভংঙ্কর অপরাধী। অসৎ সঙ্গে তাদের জীবন হচ্ছে পংকিলতায় পরিপূর্ণ।
সন্তান ধ্বংসের পথে ধাবিত হচ্ছে। বাবা-মাকে এ জন্য শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরতে হবে। সন্তানের প্রতি বাবা হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। যার ঔরসে সন্তানের পৃথিবীতে আগমন সেই বাবা সন্তানের জন্য যেন এক নিবিড় ছায়া। যার কাজ দুঃখকষ্ট থেকে দূরে সরিয়ে রেখে সন্তানকে ভালোবাসার আর্দ্রতা উপহার দেওয়া। রক্তের বাঁধনে বাঁধা চমৎকার সম্পর্ক বাবা ও সন্তানের। সন্তান ও বাবার সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে শ্রদ্ধা। বাবার কাছেই তার যত আবদার, যেন বাবাই তার আশ্রয়। তাই বেশিরভাগ সন্তানের চোখে বাবাই শ্রেষ্ঠ মানুষ। পুত্র জীবনযুদ্ধে বাবাকে মুলত সেনাপতি হিসেবে দেখে, যার শাসনাধীনেই চালিত হয় তার যাপিত জীবন। শৈশব কৈশোরে পিতাই হন পুত্রের ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। অন্যদিকে পুত্রের মাঝে সাধারণত পিতা নিজের ছায়া দেখতে পান কিংবা দেখতে চান নিজের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাতে না পারা বাবা তার সন্তানের মাধ্যমে সেই আশা স্বপ্ন পূরণের নতুন স্বপ্ন বুনতে থাকেন। ব্যর্থ স্বপ্ন ও সাধ পূরণ করতে চান বাবা সন্তানের মাধ্যমেই। আর সন্তানও বেশিরভাগ সময় প্রভাবিত হয় বাবার ব্যক্তিত্বের ছায়ায়।
আধুনিক জীবন যাপনে বাবা ও সন্তানের সম্পর্কের সমীকরণ অনেকটা ওলটপালট হয়ে গেছে। এখন বাবার কাছে আপন সন্তানকে অনেক সময় বড্ড অচেনা মনে হয়। আজকাল বাবা ও ছেলে সম্পর্কে ক্ষেত্রে অনেক অবনতি ঘটেছে। কমিউনিকেশন গ্যাপটা দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে। ব্যক্তিত্বের সংঘাত পারিবারিক জীবনে অস্বস্তি, বিশৃঙ্খলা, অবিশ্বাস, দুঃখ-যন্ত্রণা বাড়িয়ে তুলছে কেবলই। সন্তানের কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া উচিত নয়, তাকে বড় করে তুলতে, যোগ্য মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হতে এবং পথ চলতে বাবা তার জন্য কত ত্যাগ করেছেন, জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আনন্দ বিসর্জন দিয়েছেন। এ জন্য বাবাকে কতটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আবার অন্যদিকে সন্তানেরও উপলব্ধি করা উচিত বাবা বিনিময়ে কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে তার জন্য এতো কিছু করেননি। পিতারও বোঝা উচিত সন্তানকে যুগের দাবি মেটাতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। একটি মেয়ের জীবনে প্রথম পুরুষই হচ্ছে তার বাবা। বাবার সঙ্গেই তার যত খুনসুটি। বাবার কাছে যত চাওয়া-পাওয়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিস্টার রাইট হচ্ছে তার বাবা। এত বড় জগৎ সংসারে একটি শিশুর জন্য বাবা হলেন সবচেয়ে বড় শক্তি। পরিবারে একটি শিশু তার নিষ্পাপ চোখে বাবাকে দেখে পরিবারের সবচেয়ে ক্ষমতাধর, জ্ঞানী, স্নেহশীল ও পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে। শিশুদের কাছে বাবাই হন আদর্শ মানুষ ও অনেক শক্তি আর অনুপ্রেরণার উৎস। আমরা যদি প্রত্যেকে নিজের জীবনটাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করি তাহলে বাবা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে চোখের সামনে, মনের পর্দায় ছায়া ফেলেন। বাবা যে বাবাই। তার সঙ্গে অন্য কারো তুলনা চলে না। যার কারণে এই পৃথিবীর রঙ, রূপ, সৌন্দর্য দেখার সুযোগ লাভ করেছি সবাই সেই বাবা নামটির সঙ্গে যে অপার স্নেহ আর মমতার অদ্ভুত এক মিশেলে আর দৃঢ় বন্ধনে আমরা জড়িয়ে থাকি। একজন ছেলে কিংবা মেয়ের জীবনে সবচেয়ে প্রিয় এবং সর্বধিকবার উচ্চারিত শব্দগুলোর মধ্যে ‘বাবা’ই অন্যতম। একজন শিশু পৃথিবীতে আসার পর আধো আধো বোলে যখন কথা বলতে শুরু করে তখন তার মুখ থেকে ‘বাবা’ এবং ‘মা’ শব্দ দুটি প্রথম উচ্চারিত হয়। বাবা যেন সন্তানের কাছে এক মহীরুহ। সন্তানের মুখে বাবা ডাক শুনে যে কোনো বাবাই পুলকিত হন।
সীমাবদ্ধ বলয়ে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকে আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসার অবিরাম ধারা বয়ে চলে বছরের প্রতিটি দিন। জীবনের ঘানি টানতে টানতে বাবা এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন, বয়সের ভারে ন্যুব্জ হন, বার্ধক্য তাকে গ্রাস করে। তখন তিনি হয়ে পড়েন অনেকটা অসহায়, দুর্বল। রোগব্যাধি তাকে আরো বিপর্যস্ত করে তোলে। এ সময় বাবা চান সন্তান যেন তার পাশে থাকে। সব সময় যেমন তিনি ছিলেন সন্তানের পাশে তার সব প্রয়োজনে পাশে, যখন সন্তান ছিল শিশু অবস্থা। সন্তানের কাছ থেকে অবহেলা কিংবা দুর্ব্যবহার পেলে বাবার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
আমাদের সবার উচিত বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া। তারা বৃদ্ধ বয়সে যাতে কোনোভাবে অবহেলার শিকার না হন সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। অনেক সন্তান রয়েছে, যারা মা-বাবার দেখাশোনার প্রতি খুব একটা মনোযোগী নয়। মা দিবস বা বাবা দিবস তাদের চোখের সামনের পর্দাটি খুলে ফেলে বাবা-মায়ের প্রতি তার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পারিবারিক বন্ধনকে আরো অনেক সুদৃঢ় করতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমাদের আচরণ যেন কোনোভাবেই বাবা-মায়ের মনে আঘাত করতে না পারে সেদিকে বিশেষভাবে মনোযোগী হতে হবে সবাইকে।
সুখ, দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মহাকাব্যে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের অবদান কম নয়, সম্পর্কের ব্যাখ্যায় তা যাই হোক না কেন। পরিবার মানেই ভালোবাসার অটুট বন্ধন। একক কিংবা একান্নবর্তী ধরনটা যাই হোক না কেন; সবাই চায় পরিবারটা হয় যেন সুখের সমুদ্র। যাতে ভাসবে আপন মানুষের সুখভরা প্রতিচ্ছবি। এ হবে এমন এক মরুদ্যান যাতে সবাই খুঁজে পাবে অপর সুখের সন্ধান। পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের যথাযথ দায়িত্ব পালন এবং বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের যত্নবান হওয়াটা মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হলেও তা পালনে আন্তরিক ও সচেষ্ট নন অনেক মানুষ। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খোঁজ-খবর রাখেন না অনেক ছেলেমেয়ে। নানা কষ্টে-দুর্ভোগে অসহায়ভাবে জীবনযাপন করেন তারা, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। পিতা-মাতার প্রতি সন্তানদের দায়িত্ববান করতে সংসদে আইন পাস হয়েছে। পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলাকারীদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এই আইন অনেককে দায়িত্ববান এবং সিরিয়াস করবে হয়তোবা। তবে এ ক্ষেত্রে আইনের চেয়ে হৃদয়ের একান্ত আবেগ অনুভূতিটাই বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। সন্তানের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত মাতা-পিতার সকল রকম সুখের দিকে লক্ষ্য রাখা। পিতা-মাতার শারীরিক, মানসিক সকল সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে সন্তানের দৃষ্টি দিতে হবে। মাতা-পিতার মনে আঘাত লাগে তেমন কর্মকাণ্ড থেকে সব সময় বিরত থাকতে হবে। মাতা-পিতার ভরণপোষণের দায়িত্বটাকে কোনোভাবেই বোঝা না ভেবে এটাকে জীবনের একটি প্রধান দায়িত্ব বিবেচনা করতে হবে। মা-বাবা যখন বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছেন তখন তারা কর্মজীবন থেকে অবসর জীবনে পৌঁছে যান। অনেকেই তখন সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হন। এই অবস্থায় তাদের সব রকমের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা সন্তানের কর্তব্য। নিজের জীবনে অভাব, অভিযোগ, সমস্যা, সংকট যতই থাকুক না কেন তার পরও পিতা-মাতার সুখ স্বাচ্ছন্দের বিষয়টাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কোনোভাবেই তাদের অবাধ্য হওয়া যাবে না। তাদের স্বাস্থ্যের দিকে দৃষ্টি রাখতে। অনেক বাবা-মা নিজে অশিক্ষিত হলেও সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করেন অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে। কর্মজীবনে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর অনেক সন্তান অশিক্ষিত বাবা-মাকে স্বীকার করতে লজ্জা পান, তাদের পরিচয় দিতে বিব্রতবোধ করেন। তাদের মতো নরাধম আর কেউ হতে পারে না। সেইসব নরাধমের জন্য করুণা হয়। আসুন, আমরা সবাই আইনে কারণে নয় যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করি, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের সেবা যত্নে নিজেদের সর্বোতভাবে উৎসর্গ করি।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ