শিরোনাম: |
ওমিক্রনে আতঙ্ক নয় সচেতনতা জরুরি
রায়হান আহমেদ তপাদার
|
![]() এদিকে, বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ফ্রান্সে যে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে, তা ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। এই পরিস্থিতি স্পষ্টতই ইউরোপীয় দেশগুলোসহ সারা পৃথিবীর জন্যই গুরুতর সতর্কবার্তা। ইউরোপীয় এই দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকা এবং আকাশপথ সক্রিয়া থাকায় এখনই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ জোরদার করা দরকার। অবশ্য, ইউরোপে ওমিক্রনের সংক্রমণ বাড়তে থাকলেও আশার বাণী শুনিয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। তারা বলেছেন, ওমিক্রনে আক্রান্ত হলেও ঝুঁকি কম। এ ছাড়া যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তাদের সেখানে অল্প দিন থাকতে হচ্ছে। কেউ যদি ওমিক্রনে আক্রান্ত হন, তবে তার গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা করোনার অন্য ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের তুলনায় কম। বিশ্বজুড়ে এ নিয়ে গবেষণা চলছে। এসব গবেষণায় বলা হচ্ছে, ওমিক্রনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শারীরিক অবস্থা ডেল্টায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের তুলনায় ভালো। এ ছাড়া ডেল্টায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের তুলনায় ওমিক্রনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কম। ওমিক্রন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে সংক্রমণ আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার নতুন ধরনের এ অতিসংক্রমণ প্রবণতাকে সুনামি আখ্যা দিয়েছে। বাংলাদেশেও ওমিক্রন আক্রান্ত রোগী দ্রুত বাড়ছে। বাড়ছে করোনা। এ ছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে প্রবেশ করছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। এতে দেশ বেশ ঝুঁকির মধ্যেই আছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রতিবেশী ভারতেও করোনার নতুন ধরন দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে শুরু হয়েছে তৃতীয় ঢেউ। এখন কোনো ধরনের বিধি-নিষেধ ও কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা নেই। অবাধে মিশছে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনদের সঙ্গে। দাওয়াতে, সামাজিক অনুষ্ঠানে, সেমিনারে, আলোচনা সভায় অংশ নিচ্ছে। বিমানে-বাসে-ট্রেনে চড়ে যাচ্ছে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। সম্প্রতি দেশে হঠাৎ করে করোনা সংক্রমণ ফের বাড়ার পেছনে এর একটা যোগসূত্র রয়েছে বলে আমরা মনে করি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে করোনা সংক্রমণ ৬০ শতাংশ বেড়েছে। সংক্রমণের হার এক শতাংশ থেকে প্রায় চার-সাড়ে চার শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ অবস্থায় পর্যাপ্ত জেনোম সিকোয়েন্সিং না করলে ওমিক্রনের বিস্তার কেমন, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ শুরু হয়েছে কিনা, তা বোঝাটা মুশকিল। জনস্বাস্থ্যবিদরা আশঙ্কা করছেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে দেশে ওমিক্রন বড় মাত্রায় আঘাত হানতে পারে। সেটি সামাল দিতে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কতটুকু প্রস্তুত সেটিই বিবেচ্য বিষয়। বিশেষ করে দ্বিতীয় ঢেউয়ে স্বল্প সময়ে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরেও মানুষ চিকিৎসা পায়নি। কোথাও একটা শয্যা খালি নেই। প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ নেই। আইসিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা নেই। এটা ছিল এক সাধারণ চিত্র। ফলে শুধু কোভিড রোগী নয়, নন-কোভিডের চিকিৎসাও ব্যাহত হয়েছিল। বিশেষ করে প্রসূতি ও শিশুসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছিল। কোভিড রোগী আর নন-কোভিড রোগীকে কীভাবে চিকিৎসা দেওয়া হবে, কোথায় দেওয়া হবে, তার জন্য ছিল না সুসমন্বিত ও কার্যকর পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনা। এতে হাসপাতালে এসেও অনেকেই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিল। চিকিৎসা ছাড়াও কোভিড পরীক্ষার ক্ষেত্রে এক ধরনের দোদুল্যমানতা ছিল। কোভিড সংক্রমণের বিস্তার রোধের প্রাথমিক করণীয় হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বারবার তাগিদ সত্ত্বেও দ্রুত বিপুলসংখ্যক মানুষের কোভিড পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রথম দিকে শুধু সরকারি সংস্থার হাতেই পরীক্ষার এখতিয়ার সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে পরীক্ষার অনুমোদন দিতে পার হয়েছিল দীর্ঘ সময়। সরকারের তরফেও পর্যাপ্তসংখ্যক পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ চলেছিল ঢিমেতালে। তার মধ্যে কতগুলো বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে কোভিড পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, যারা ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছিল। এতে বহির্বিশ্বে সংকটে পড়েছিল দেশের ভাবমূর্তি। আরো হতাশাজনক দৃশ্যপট হলো, দুর্যোগের মধ্যেও স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা বন্ধ ছিল না। এন-৯৫ মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) এবং অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা ও বিতরণের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। মোটাদাগে স্বাস্থ্য খাতে এক বিশৃঙ্খল, নৈরাজ্যিক চিত্র দেখা গিয়েছিল, যার পুনরাবৃত্তি আর কাম্য নয়। সাম্প্রতিক অতীতের অভিজ্ঞতাকে এখন কাজে লাগেতে হবে। গত সেপ্টেম্বর থেকে দ্বিতীয় ঢেউ দেশে অনেকটা নিষ্প্রভ হওয়া শুরু করেছিল। সংক্রমণ আস্তে আস্তে কমে আসছিল। এখন আবারো যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে সার্বিক বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে জনগণের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী, ওষুধ, আবশ্যকীয় উপকরণ মজুদ বাড়াতে হবে। দ্রুততার সঙ্গে পরীক্ষায় প্রয়োজনীয়, রি-এজেন্ট, ভেন্টিলেটরসহ অন্য আবশ্যকীয় চিকিৎসা পণ্য দেশে মজুদ রাখতে হবে। এ ব্যাপারে দ্রুত কিছু না করলে সামনে সমূহ বিপদ। করোনাভাইরাস অতিমারির কবলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিশ্ব। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে করোনার তৃতীয় ওয়েভে ভারত থেকে উদ্ভুত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে দেখা দেয়। প্রায় দেড় বছর ধরে করোনা লকডাউনে বিপর্যস্ত জীবনযাত্রা আবারো থমকে দাঁড়ায়। পশ্চিমা বিশ্বে ইতোমধ্যেই অধিকাংশ নাগরিকের ভ্যাক্সিনেশন নিশ্চিত হওয়ায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট তেমন কাবু করতে না পারলেও এবার আগের যে কোনো ভেরিয়েন্টের চেয়ে তিনগুণ বেশি সংক্রামক ওমিক্রনের লক্ষণগুলো মৃদু হলেও অতিমাত্রায় সংক্রমণের কারণে এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য অনেক বেশি হুমকি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। ওমিক্রনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে, পূর্ণডোজ ভ্যাক্সিন নেওয়া ব্যক্তিরাও এতে আক্রান্ত হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বে ওমিক্রনে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পড়া ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়ার শুরুতেই বিশ্বের যে সব দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশের নামও ছিল। যদিও তখনো বাংলাদেশে কোনো ওমিক্রন সংক্রামক রোগী ধরা পড়েনি। ডিসেম্বরের ১০ তারিখে দেশে প্রথম দু’জন নারী ক্রিকেটারের দেহে ওমিক্রন ভাইরাস ধরা পড়ে। তারা ইতোমধ্যেই সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। তবে সংক্রমণ যে ওই দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই তা ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়েছে। গত কয়েক দিন যাবত করোনা ওমিক্রন সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং মৃত্যুর হারও বাড়ছে। যেখানে করোনা সংক্রমণে মৃত্যুহার শূন্যের কাছাকাছি চলে এসেছে, সেখানে নতুন করে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণ হার বৃদ্ধির প্রবণতা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যেই ওমিক্রন নিয়ে নতুন সকর্তবার্তা দিয়েছে। চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলো করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ধরন ওমিক্রন প্রতিরোধে নতুন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এহেন বাস্তবতায় বাংলাদেশকেও নতুনভাবে ভাবতে হবে। করোনা লকডাউনের ফলে দেশের আর্থ-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানে যে বেহাল অবস্থা দেখা দিয়েছে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার আগেই ওমিক্রনের চোখ রাঙানি বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখতে হবে। একদিনেই চারজনের দেহে ওমিক্রন সংক্রমণ ধরা পড়ায় এর সম্ভাব্য প্রার্দুভাব নিয়ে দুশ্চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। শুরু থেকেই দেশের করোনা শনাক্তকরণ ব্যবস্থা এবং নিম্নহার নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। সংক্রমণ কমে আসার সাথে সাথে করোনা স্বাস্থ্যসেবা ও শনাক্তকরণ ব্যবস্থাও আরো স্থিমিত হয়ে পড়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কোথাও আর আগের মতো মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যাচ্ছে না। করোনা সংক্রমণ নিয়ে সাধারণ মানুষের ভয়-আতঙ্ক কেটে গেলেও সংক্রমণের ঝুঁকি ও এর সামাজিক-অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমে যায়নি। করোনার কারণে দেশের কয়েক কোটি মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে অতি দারিদ্র্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। এ ছাড়া দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক বাস্তবতায় আরেকটি করোনা লকডাউনের চাপ সহ্য করা অসম্ভব হবে। এহেন বাস্তবতায় ওমিক্রন প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষত ওমিক্রন শনাক্তরণ ব্যবস্থা জোরদার ও সহজলভ্য করার পাশাপাশি মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা কঠোরভাবে অনুসরন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শৈথিল্য কাটিয়ে প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষীয় নজরদারি বাড়াতে হবে। ইতোমধ্যেও ভারতেও ওমিক্রন সংক্রমণ বাড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। অতএব ভারতসহ আন্তরাষ্ট্রীয় বিমান যোগাযোগ ও সীমান্তপথে যাতায়াতে কড়াকড়ি আরোপসহ শনাক্তকরণ ব্যবস্থা জোরদার করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। রাস্তায় ও গণপরিবহনে সব যাত্রী ও পথচারিকে মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে হবে। সাবান-সেনিটাইজারে হাত ধোয়াসহ সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কে সকলকে সচেতন থাকতে হবে। সংক্রমণের লক্ষণগুলো খুব মৃদু হওয়ায় ওমিক্রনের গণসংক্রমণের আশঙ্কাও অনেক বেশি। ওমিক্রনের ঝুঁকি রোধে নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। বয়স্কদের বুস্টার ডোজের পাশাপাশি স্বল্প সময়ের মধ্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের করোনার টিকা নিশ্চিত করতে হবে। সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগে ওমিক্রনের গণসংক্রমণ প্রতিরোধ করা অসম্ভব নয়। তাই নিজে সতর্ক থাকুন অন্যকে সতর্ক থাকতে সহযোগিতা করুন। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট। আজকালের খবর/আরইউ |