সোমবার ৫ জুন ২০২৩
ওমর আলীর কবিতা মানে বাংলাদেশ
মামুন মুস্তাফা
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২২, ৮:০৭ PM
বলা হয়ে থাকে, ’৪৭ উত্তর দেশভাগের পটভূমিতে বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার যাত্রা শুরু। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ওই সময়ে তদানীন্তন দুই পাকিস্তানের মধ্যকার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবদমনের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন বাংলা ও বাঙালির সমাজ অভ্যন্তরে সংঘটিত নানা দান্দ্বিক চারিত্র্য বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্যের ভিত্তিভূমি রচনা করে দেয়। সেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের কবিতায় পুরোদস্তুর রোমাঞ্চকর অনুভূতি দিয়ে পেলব এবং মাটি ও মানুষের প্রেমানুভূতির আখ্যান গড়ে তোলেন দূর মফস্বলের কবি ওমর আলী।

দেশভাগের পটভূমিতে যে গুটিকয়েক কবি মাতৃঐতিহ্যের শেকড়ে নিজেকে প্রোথিত করলেন, তাদেরই একজন কবি ওমর আলী। কাব্যপ্রতিভা তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। কবিতাই ছিল আরাধ্য দেবতা। ১৯৬০ সালে কবির প্রথম কবিতাগ্রন্থ এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কবিতায় স্বাতন্ত্রিকতার পরিচয় দেন। সেই তখন থেকে তিনি বাংলাদেশের কবিতায় ষাটের দশকের একজন রোমান্টিক কবি হিসেবে চিহ্নিত হন। ওমর আলীর রোমান্টিকতা শুধু নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা ছিল মূলত নারী, দেশপ্রেম ও নিসর্গের মধ্যে প্রোথিত। তবে তার প্রেমাসিক্ত মন সবসময় দেশমাতৃকার সুস্থতায়ও একটি শ্যামবর্ণা স্বাস্থ্যবতী আদিম বাঙালি নারীকে খুঁজে ফিরেছে-

তুমি সেই নারী, যাকে পৃথিবীর একটি পুরুষ
ভালোবেসে ডেকেছিল, ‘এসো, তুমি প্রিয়তমা হবে।’
বলেছিল, তুমি মোর ভালোবাসা তুলে নাও, নারী,
তোমার শরীরে, মনে, সমস্ত মধুর অনুভবে। 
(সেই নারী তুমি/এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি)

এখানে কবি নিজেকে একজন সম্পন্ন ও সম্পূর্ণ নারীর কাছে সমর্পণ করেছেন। ভালোবাসাকে অমৃতের ন্যায় পান করেছেন। প্রিয়তমা নারীর কাছে শরীর, মন এবং সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে মধুর অনুভবে গ্রহণ করার জন্য আকুতি জানিয়েছেন। ওমর আলীর কবিতায় মানব-মানবীর ভালোবাসার বর্ণনা শিল্পমাধুর্যে শ্বাশত হয়ে ধরা দেয় পাঠকের কাছে। আমরা জানি যে, সুন্দরের দূরত্ব রক্ষা করা শিল্পী-সাহিত্যিকদের একটি অবশ্যমান্য পূর্বশর্ত। কবি ওমর আলীর প্রেম-সৌন্দর্যের প্রতি পূজারী মন তা মেনে চলেছে পালনীয় কর্তব্য হিসেবে। সেই সুন্দরের দূরত্বেও অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে রোমান্টিসিজম। সেখানে ক্ষোভ, ক্রোধ এবং ঘৃণারও জন্ম হতে দেখা যায়।
 
তিনি কোনো বিশেষ নারীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন কিনা জানা নেই, তবে ভালোবাসার অগ্নিতে পুড়েছেন কবি আপন মনে। তাই তো ওমর আলীর কবিতা আজন্ম প্রেমাসক্ত। আগেই বলেছি ওমর আলীর কবিতার মিথষ্ক্রিয়া- নারী, দেশাত্মবোধ ও প্রকৃতির সঙ্গমে। আর তাই তিনি সুন্দরের দূরত্বে নিজেকে নির্বাসনে রেখেছেন দীর্ঘ সময় সুদূর মফস্বল শহরে। বলা যায়, ‘আধুনিককালের কবিতার মেজাজমর্জি সচেতনভাবে ধারণ’ করেই তিনি ‘গ্রামীণ জীবনসংস্কৃতিকে অবলম্বন’ করে কবিতা লিখেছেন-

এখন প্রিয় নদী আমার নিকটেই,
হিমেল বাতাসের আরাম বোধ করি,
চপল পানি ছুঁতে আমার ভয় নেই, 
যেমন ছুঁয়ে যায় উজানে খর তরী। 
(নদী/নদী, নরকে বা স্বর্গে)

অথবা ‘লোকটা সূতী কাপড় পরেনি, পরেছে শুধু মাটি’- নিজের কবিতার এই চরণের মতো ওমর আলী গ্রামীণ অধিবাসকে অঙ্গীভূত করেছিলেন আপাদমস্তক। তার সব কবিতাগ্রন্থ গ্রামের নিখাঁদ গন্ধে ভরা। একই সঙ্গে গ্রামের মানুষের আনন্দ-বেদনা, দুঃসহ জীবন যন্ত্রণাকে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন; একই সঙ্গে দেশ-কাল-সমাজ, রাষ্ট্র-স্বাধীনতা, জৈবিক-প্রবৃত্তি প্রভৃতি বিষয় গ্রামীণ সমাজেরও অনুষঙ্গ, সেই বাস্তবতাকে তিনি সমীকৃত করেছেন তার কবিতায়। এখানেই অনন্য সাধারণ হয়ে ধরা দিয়েছেন কবি ওমর আলী। তার প্রতিটি কাব্যই সেই সাক্ষ্য বহন করে। এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি, ডাকছে সংসার, হৃদয় ছুঁয়ে আছে ঝড়, তোমাকে দেখলেই, আমার ভেতর খুব ভাঙচুর হচ্ছে, ফেরার সময়, গ্রামে ফিরে যাই, তেমাথার শেষে নদী, অরণ্যে একটি লোক, আত্মার দিকে, নদী, নরকে বা স্বর্গে, এখনো তাকিয়ে আছি, নিঃশব্দ বাড়ী, প্রস্তরযুগ তাম্রযুগ, স্থায়ী দুর্ভিক্ষ সম্ভাব্য প্লাবন, লুবনা বেগম- এরকম তার প্রায় প্রতিটি কাব্যেই গ্রামের গন্ধ ঘুরেফিরে নাকে এসে লাগবে।

একটা সময় গেছে যখন কবি এই মুখোশ আঁটা দানবীয় রাজধানীর বুকে জীবিকা নির্বাহে হেঁটে গেছেন তেপান্ন গলির এই শহরে। ভূতগ্রস্ত এই শহর তাকে অভিবাদন জানিয়েছে কপট ভদ্রলোকের মতো। তাই কবির সেই ঘোর কাটতে সময় লাগেনি খুব বেশি। তিনি অনুভব করেন সংকীর্ণ জীবনের কোনো মানে হয় না। কী দিতে পারে এই শহর। উদার আকাশ গুমোট হয়ে ধরা দেয়। সেখানে দেখা মেলে না কোনো শুকতারার কিংবা কালপুরুষ, যে কিনা জয় করতে পারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। অথবা নদীর কূলে স্বজনের বাঁশি, এখানে জলে ভাসা পদ্মের মতো কূলবধূর আঁকশিও ভাসে না। তিনি তাই গ্রামের আলোবাতাসে নিজেকে মুক্ত করতে চান। এখানেই কবি গৃহি হয়ে ওঠেন। সংসার কবিকে হাতছানি দেয়-

এখন শিবরামপুর কোশাখালী গা’র আনোয়ারা রহিমার
হাতে কিন্তু গোবরের কণামাত্র নেই
ফেনায়িত দুধের সুস্বাদ আর সুমিষ্ট ঝর্ণা
যুগল হাঁটুতে ধরা মাটির দোনায় সাদা চন্দ্রকিরণ টেনে
নামছে যে জন
কালো এক গাভীর ওলান থেকে কলিমের বউ সোনাভান...
(সবুজ সুনীল মাছরাঙার দেশে/ডাকছে সংসার)

ওমর আলীর কবিতায় যে গ্রামীণ অনুষঙ্গের কথা বলছি, কিংবা তার সংসার যে গ্রামীণ জনপদে- তার অর্থ এই নয় যে, তিনি আধুনিক নন। এই বাংলার জলগাওয়া নিসর্গনির্ভর, যেখানে লেগে আছে মাটি ও মানুষের গন্ধ, যেখানে বাজে মা আর প্রিয়তমার কিন্নর পায়ের ছন্দ, কাঁকন আর কাঁকইয়ের স্পর্শ। সে তো ওই পল্লীবালাতেই সম্ভব। আর তাই তো কবি ওমর আলীর কবিতা- গাঁয়ের পথ, ঢেঁকির শব্দ, বাঁশঝাঁড়, কলাগাছ, পাখ-পাখালি, ডিঙি নৌকা, পদ্মবিল, পুঁটি, ট্যাংরা, বক, বটগাছ, শরবন, নারিকেল তলা, পুকুর, মুঠো মুঠো শস্য, আবডাল, বুনোলতা, ঘাস, বৃষ্টি, মৃত্তিকা, রোদ, বিটপী ছায়া, বনতল, কফিন, সাতভাই চম্পা, বেড়িবাঁধ, রূপসী মৃগয়া, হাইহিল জুতো, ভাত কাপড়, দেনমোহর, মেঠোফুল- এরকম অজস্র শব্দ ব্যবহারে আধুনিক জীবনের টানাপোড়েনকে আবিষ্কার করে।  

আর এর ভেতর দিয়েই দেশাত্মবোধ ওমর আলীর কবিতার একটি প্রধান প্রসঙ্গ। স্বদেশের জন্য কবির ভেতরে গভীর স্বপ্ন যেমন লালিত, আবার স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাও বিদ্যমান। কেননা গ্রামীণ জনপদের মানুষও এই দেশেরই সন্তান। ফলে তার কবিতায় এদেশের মানুষের আত্মপরিচয়, রাজনৈতিক অধিকার, রাজনীতির নামে স্বদেশের রক্তক্ষরণে তো খেটে-খাওয়া গ্রামের মানুষেরই জীবন সবার আগে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আর তাই সমাজ, সময়, রাষ্ট্র ও অভিজ্ঞতাকে তিনি কবিতায় গ্রহণ করেছেন- ‘কিছুতেই মনে পড়ে না যে আমার স্বদেশ কোথায় রেখেছি/ কিছুতেই মনে পড়ে না যে এত কষ্টে পাওয়া যে স্বদেশ আমার/শরীরেই বদরক্তে বন্দী হয়ে আছে।’ 
(স্বদেশ/স্বদেশে ফিরছি)

তবু সেই কষ্টের ভেতরে তিনি স্বদেশ বলতে মা মাটি আর মানুষের কাছেই ফিরেছেন। প্রিয়তমাসম মাতৃভূমির বুকে কোনো শকুনের স্থান নয়, আজন্ম লালন করেছেন শ্যামল রঙ রমণীর মুখ। যে মুখ দেখে শিশু হেসে ওঠে, যে মুখ দেখে বিপথগামী হয় না কিশোর, যে মুখ দেখে যুবক ভালোবাসতে শেখে তার দেশকে, যে মুখ দেখে কঠিনেরে ভুলে যায় গৃহস্বামী। যাপিত জীবন শেষে যে মুখ দেখে বলতে পারে পুরুষ-

এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;
সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে,
রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা।

সে চায় ভালবাসার উপহার সন্তানের মুখ,
এক হাতে আঁতুড়ে শিশু, অন্য হাতে রান্নার উনুন,
সে তার সংসার খুব মনে-প্রাণে পছন্দ করেছে;
ঘরের লোকের মন্দ-আশংকায় সে বড় করুণ। 
(এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি/এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি)

গ্রামীণ সমাজের নারীদের ছোট ছোট স্বপ্ন, স্নেহ-মমতা, চাওয়া-পাওয়া, গৃহের মায়া, পরিবারের প্রতি ভালোবাসা, সন্তান উৎপাদনের গর্বের কথাচিত্র কবির কবিতায় ক্যামেরার মতো এসে ধরা দেয়। সবচেয়ে বড় কথা মাটির সঙ্গে থেকেছেন তিনি, মাটির মানুষকে স্পর্শ করে থেকেছেন। সুতরাং ওমর আলীর কবিতায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায়। আর তাই বাংলাদেশের কবিতাপাঠে কবি ওমর আলীকে পাঠ করতে হবে নিবিষ্ট চিত্তে।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক।
আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
নান্দাইল পৌর সদরে এক রাতে তিন বাসায় চুরি
শিক্ষাবিদ নূরুল ইসলাম ভাওয়ালরত্নের ইন্তেকাল
নতুন বছরে জঙ্গি মোকাবিলায় প্রস্তুত র‌্যাব: ডিজি
বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন মারা গেছেন
২০২৩ হোক অগ্রযাত্রার আরেকটি বছর: সজীব ওয়াজেদ জয়
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলা গান
পরীমনির জীবনটা আমার জীবনের মতো: তসলিমা
এভাবে চলে যেতে নেই
নোয়াখালীতে একক আয়োজনে একসঙ্গে ১০ জুটির বিয়ে
নোয়াখালীতে ১০ তরুণ-তরুণীর গণবিয়ে
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft