শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। কোনো জাতিকে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে শিক্ষার বিকল্প নেই। পৃথিবীতে যে জাতি যত শিক্ষিত, জ্ঞান-বিজ্ঞানে তারা তত এগিয়ে; বিশ্ব নেতৃত্বের কলকাঠি তাদের হাতেই। শিক্ষা জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিরও অন্যতম নিয়ামক। এটি একজন ব্যক্তির অন্তরাত্মাকে যেমন বিকশিত করে, তেমনি সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতেও সাহায্য করে। বাংলাদেশসহ প্রতিটি দেশই তাই শিক্ষাকে এবং অবশ্যই লিঙ্গ বৈষম্যহীন শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের সংবিধানেও লিঙ্গ বৈষম্যহীন শিক্ষার কথাই বলা হয়েছে। সংবিধানে ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান’ বলার পাশাপাশি রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাবে না বলে বলা হয়েছে। সুতরাং কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া, লেখাপড়া করা এবং সেখানকার সকল সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সকল নাগরিক-ই যে সমান অধিকারের দাবিদার, তা বলাই বাহুল্য। অথচ সম্প্রতি দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের পাঁচটি হলে এবং মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলেমা খাতুন ভাসানী হলে বিবাহিত ছাত্রীদের থাকার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। বিবাহিত ছাত্রদের ক্ষেত্রে এমন নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও বিবাহিত ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এমন নিষেধাজ্ঞা অমানবিক তো বটেই নারীদের জন্য তা চরম অবমাননাকরও।
বৈষম্য কি শুধু এখানেই। অন্য হলের ছাত্রীরা তো নয়-ই বরং একই হলের ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও শুধু আবাসিক না হওয়ার কারণে নিজের হলে পর্যন্ত ঢুকতে পারে না মেয়েরা। অথচ ছেলেদের হলগুলোতে নেই এমন কোনো বাধানিষেধ বা কড়াকড়ি। একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে ছেলে ও মেয়েদের জন্য এমন ভিন্ন নীতি কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যেখানে সারা বিশ্বে নারী শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, এমনকি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-তেও ২০৩০ সালের মধ্যে শিক্ষার সকল স্তরে বৈষম্যহীন নারী শিক্ষা, নারী-পুরুষের সমানাধিকার ও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে এ ধরনের বৈষম্যমূলক নীতি নারীদের শিক্ষা ও তাদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে চরম বাধা বৈকি।
বর্তমান সরকারও নারীদের শিক্ষার হার বাড়ানোসহ নারী ক্ষমতায়নের জন্য বদ্ধপরিকর। যে কারণে প্রাথমিকে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনা, বাল্যবিবাহ রোধ, মেয়েদের উপবৃত্তি প্রদানসহ নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যাতে কোনোভাবেই কোনো মেয়ে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয় এবং তারা যাতে শিক্ষিত হয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এই ধরনের বৈষম্যমূলক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রকারান্তরে নারীদেরকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এবং তাদেরকে ছোট করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সেরা বিদ্যাপীঠ। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে এর অবদান যেমন অসামান্য, তেমনি দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রসারে এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরিতেও এর অবদান অনন্যসুলভ। হাজার হাজার শিক্ষার্থী এখান থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে দেশ-বিদেশে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছে ফি বছর। বর্তমানে প্রায় ৩৭ হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে এখানে। যার মধ্যে ১২ হাজারেরও অধিক ছাত্রী, যাদের থাকার জন্য রয়েছে মাত্র পাঁচটি হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড়ো অংশ একেবার গ্রাম থেকে উঠে আসা ছাত্র-ছাত্রী, যাদের ঢাকায় থাকার মতো কোন জায়গা-ই থাকে না। তাই হলে একটি সিট পাওয়া তাদের কাছে অনেকটা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। যে কারণে হলে পর্যাপ্ত আসন না থাকা সত্ত্বেও খুব কষ্ট করে গাদাগাদি করে থাকতে হয় তাদের। মেয়েদের জন্য থাকার সমস্যাটি আরো প্রকট। অনেক গরিব বাবার পক্ষে মেয়েকে মেসে রেখে পড়াশোনা করানোরও সামর্থ থাকে না। তাই কোনোমতে হলে একটি সিট পেলে হালে পানি পায় যেন।
সমাজ বাস্তবতার কারণে লেখাপড়া চলাকালীন অনেক মেয়ের বিয়েও হয়ে যায়। কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলেই যে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল, বিষয়টি তেমন নয়। অথচ বিয়ে করা অন্যায় না হলেও বিবাহিত মেয়েটিকে হলে থাকতে হয় অনেকটা পরিচয় গোপন করে চোরের মতো। বিবাহিত ছাত্রদের ক্ষেত্রে এমনটি দেখা না গেলেও ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য সত্যিই মানার অযোগ্য। বিবাহিত মেয়েরা কি তবে পড়াশোনা করতে পারবে না? নাকি বাংলাদেশের আইনে বিবাহিত মেয়েদের পড়াশোনা করা নিষিদ্ধ? যদি তা না হয়ে থাকে তবে বিবাহিত ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এমন উদ্ভট ও অবান্তর সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অসাংবিধানিক। এটি তাদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পথকে প্রকারান্তরে রুদ্ধ করে দেওয়া, যা নারীর ক্ষমতায়নের পথে অন্যতম একটি অন্তরায়। যদি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েদের বিবাহ করা অন্যায় না হয়, যদি বিবাহিত মেয়েদের পড়াশোনা করা নিষিদ্ধ না হয়, তবে হলে থাকতে এমন নিষেধাজ্ঞা কাম্য হতে পারে না। শুধু আসন সংকটের দোহাই দিয়ে বিবাহিত ছাত্রীটিকে বলির পাঠা বানানো কেন? এর দায় কি তার? বরং এ দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা না বাড়িয়ে শুধু বছর বছর বিভাগ বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। বিভাগ বাড়লে শিক্ষার্থী বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে অনুপাতে যদি হলে সিট বাড়ানো না হয়, নতুন হল বা হোস্টেল নির্মাণ না করা হয়, যদি নতুন সুযোগ-সুবিধা তৈরি না হয়, তবে তার দায় কেন বিবাহিত মেয়েটির কাঁধে এসে পড়বে?
যুগের চাহিদা অনুযায়ী নতুন বিভাগ বাড়তেই পারে। কিন্তু বাড়তি শিক্ষার্থীরা কোথায় থাকবে সে কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একবার চিন্তা করে কি? আর তাই শিক্ষার্থীদের হলে থাকতে হয় কষ্ট করে; দুজনের জায়গায় চারজন, কখনো বা তারও বেশি। আর যারা সেটিও পায় না, তাদের বাদুড়ঝোলা হয়ে প্রতিদিন বাসে করে এসে ক্লাস করতে হয়। দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কি দুর্বিষহ অবস্থা! যেন দেখার কেউ নেই।
ভালো শিক্ষক নেই, ভালো গবেষণা নেই, হলে থাকার ভালো পরিবেশ নেই, নেই ভালো খাবারের ব্যবস্থা, লাইব্রেরিতে আসন সংকট, দূর-দূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত বাস। শুধু নেই আর নেই। এই নেই আর নেই এর মধ্যে বিবাহিত ছাত্রীরা একটু হলে থাকলেই বা দোষের কী আছে। তারা তো আর অবৈধ ছাত্রী নয়। অথচ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ছাত্রত্বহীন অবৈধ ছাত্রীরা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর থাকলেও তাদের বেলায় প্রশাসন যেন নীরব। বিবাহিত বৈধ ছাত্রীদের না তাড়িয়ে একবার তাদের তাড়ান না? তাতে কিছুটা হলেও তো আবাসন সংকট কমবে। বিবাহিতদের বের করে দিলেই আবাসন সংকটের সমাপ্তি ঘটবে না। বরং এর জন্য দরকার সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে এগুলো নিরসনে আরো তৎপর হতে হবে। কেননা তারা কোনভাবেই এর দায় এড়াতে পারেন না।
আবাসন সমস্যা দূরীকরণের জন্য নতুন হল নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। যারা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ছাত্রত্ব শেষ হওয়া সত্ত্বেও অবৈধভাবে হলে থাকে, তাদের বের করে দিতে হবে। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না বাড়িয়ে শুধু নিত্য নতুন বিভাগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের আরো চিন্তার অবকাশ রয়েছে। শুধু ‘বিবাহিত’ তকমা দিয়ে মেয়েদেরকে হল থেকে বের করে দেওয়া কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। এতে কেবল সমস্যাই বাড়বে। বাসি ডাল আর মোটা চালের ভাত আধা-অল্প খেয়ে কোনো রকম মাথা গুঁজে হলে থাকা মেয়েটিকে বের করে দিবেন না প্লিজ। এতে একটি স্বপ্ন হয়তো নিভে যেতে পারে নিমেষেই; থেমে যেতে পারে একটি দরিদ্র পরিবারের আজন্ম লালিত স্বপ্ন-আশা। অধরাই থেকে যেতে পারে নারীর ক্ষমতায়ন।
লেখক : প্রভাষক, সাভার সরকারি কলেজ, ঢাকা।
আজকালের খবর/আরইউ