মঙ্গলবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
কবি ও কবিতার সংসার
রায়হান উল্লাহ
প্রকাশ: শুক্রবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২১, ২:৩৫ পিএম
কবি কী এবং কে? কবিতা কী? এমন প্রশ্ন সারা জীবনের। সুরাহা মেলেনি। কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। এখন কথা থাকে, এ কেউ কেউ কারা? কেমন তাদের জীবন? কেমন তাদের কাব্যের সংসার? কেমন তাদের সবকিছু? 

জন্ম থেকেই মানুষ অসীম জ্ঞানের অধিকারী। তার ভাবনার থেকেও দূরে তার জ্ঞান। কেউ কেউ সেই ভাবনাকে ধরার চেষ্টা করেন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত খুঁজে বেড়ান জীবনের মানে। আর এ খোঁজাখুঁজির বিষয়াদি তিনি ভাষায় প্রকাশ করেন। এমন প্রয়াশ থেকেই কবি ও কাব্যের জন্ম। 

এখন পর্যন্ত কবিতার সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা আসেনি। ব্যক্তি বিশেষে যা এসেছে তাও সর্বজনকর্তৃক স্বীকৃত হয়নি। তবুও কবিতার কিছু সংজ্ঞায়ন যুতসই ঠেকে। এ থেকে বলা যায় কবিতা ভাষার একটি সুমধুর প্রকাশ, যা একটি ছন্দের অবতারণা করে। যাতে একটি তাল-লয় খেলা করে। সর্বশেষ একটি গুছানো ভাব প্রকাশ করে। এ ভাবেই হারিয়ে যান কিছু মানুষ। এবং হয়তোবা এ ভাব নিয়েই জন্মান কিছু মানুষ। জীবনানন্দের ভাষায় তারাই কবি।

কথা আসে কবিরা কেমন? কেমন তাদের জীবনাচরণ? কেমন তাদের ঘর-গেরস্থালি? সময়ে সময়ে অনেককেই বলতে শুনা যায়, কবি কবি লাগছে। এ কবি কবি লাগছে বিষয়টি কী? কবিদের কি নির্দিষ্ট কোনো আকার আছে? আবার অনেককেই বলতে শোনা যায়, কবি মানে কাধে ঝোলা, উসকো-খুশকো বাবরি চুল, বেভুল মন। আসলে এসব কিছুই না। কবিদের নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই। ভাব বা জীবনাচরণও নেই। কবিদের নির্দিষ্ট কিছুই নেই। শুধু কবিতা ছাড়া। কবিরা কিছু পানও না। এমনকি কিছু চানও না। এর বাইরে যাদের দেখবেন তাদের জীবনানন্দের ভাষায় ‘সকলেই কবি নয়’ এর মধ্যে ফেলে দেওয়া যায়। কবি হতে গেলে দৃশ্যত কিছুই থাকতে হবে এমন কথা নেই। কবিত্ব থাকা চাই, কবিতার চিন্তা ও মনন থাকা চাই। কল্পনার ক্ষমতা চাই।  

এখন ‘সকলেই কবি নয়’ এর ভিড়ে কারা কবি। এসবও চিন্তা ও কল্পনার বিষয়। কবিদের একটি মাথা ছাড়া আর সুনির্দিষ্ট কোনো আকার নেই। জাগতিক সবকিছুর মতোই বাকিটা ভান।

কবিদের একটি জীবন আছে। এ জীবনে তারা কী করেন? বলা যায় তারা কিছুই করেন না। আবার অনেক কিছুই করেন। এ করাকরিতে ঘুরেফিরে কবিতা থাকে। এটিই যথেষ্ট। আর কিছু না হলেও হয়। সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কবি আসছেন, যাচ্ছেন। তাদের কেউই খুব বেশি কিছু পাননি; ধন-জৌলস-জীবনাচরণ। কিন্তু বড় একটি বিষয় পেয়েছেন- কবিত্ব। এটি পেতে পৃথিবীর তাবৎ মানুষ, আরও এগিয়ে তাবৎ সাহিত্যিক উদগ্রীব হয়ে থাকেন। ঘুরেফিরে জীবনানন্দ বলয়ে। সকলেই কবি নন। তাই তার এটি পাওয়ার কথা না। কবিত্ব একজন জন্ম থেকেই নিয়ে আসেন। তার কিছুই করতে হয় না। শুধু ভাবনাদের ডালপালা ছড়িয়ে ভাষায় রূপ দিতে হয়। তা কাগজে বা মুদ্রণে না দিয়ে মুখে মুখেও দিতে পারেন। অনেকে তাই করেন। এবং চির জনমের তরে অমরত্ব লাভ করেন।

কথা থাকে এই অমরত্বের মানুষজন কি পৃথিবীটাকে মসৃণ পান? কখনো না। অন্য সবার মতোই তিনি পৃথিবী পান। এবং অনেক বেশি ধুকে যান। কারণ তাকে স্বয়ং স্রষ্টা অনন্য একটি ক্ষমতা দিয়েছেন। এর জন্যই হয়তোবা অনেক কিছু কেড়েও নিয়েছেন। অর্থ-বিত্ত-জৌলুস। আর তাতেই জন্ম থেকে মৃত্যু তিনি কাব্যজৌলুস ছড়িয়ে অনেক কিছুই মাড়িয়ে পথ চলেন। এ পথ চলতে কখনো তাকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হয়। ফের তিনি কবিত্বের শক্তিতে উঠে দাঁড়ান। কিন্তু মাথা কখনো বিকান না। কবিদের মাথা কোথাও কখনো বিকোয় না। ফলে দৈবিক তারা অর্থের অভাব নিয়েই থাকেন। কখনো তার সময় হয়ে উঠে না সময়ের স্রোতে ভেসে জীবনাচরণে বিত্ত নিয়ে আসা। তার যে আছে বিরল কবিত্ব। এমনি করেই তিনি পথ চলেন। কাব্য বাড়ান। 

কথা আসে বিরল কবিত্ব ক্ষমতা নিয়ে কবিরা সমাজ, দেশ, পৃথিবী ও ব্রহ্মাণ্ডের কী উপকার করেন? উপকার কিছু না করে থাকলেও কবিরা কোনো অপকার করেন না। সেই অর্থে আর কিছু না করলেও কবিরা সমাজ, দেশ, কালের জন্য উপকারি। আর কবিরা কি যুগ, রাষ্ট্র, কালের কিছুই করেন না? মানবসভ্যতার ক্রমবিবর্তিত ইতিহাস বলে, সৃষ্টির শুরু থেকে আজ এবং আগামী পর্যন্ত যা কিছু মহান হয়েছে এবং হবে তা কবিতা ও কবির হাত ধরেই। কবিরা আর কী করবেন? কোনো অনিষ্ঠ না করে রেনেসাঁর যোগান দিচ্ছেন; আর কী করার চায়? বিপরীতে কিছুই নিচ্ছেন না তারা। না নিলেও কিছু পাওয়া উচিত। সেটাইবা তারা পাচ্ছেন কই? জীবনের তরে ভোগ বাদ দিয়ে ত্যাগের জয়গান গাইছেন তারা। আর কিছু লাগে কি? ত্যাগ যারা করেন তারা ভালো বুঝেন ত্যাগের বেদনা। বিপরীতে তারাই ভোগ করেন ত্যাগের কালজয়ী আনন্দ। এ কষ্ট ও আনন্দ দুটোই পান কবিরা। তাদের থাকে না কোনো সম্পদ। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার-পরিজন-বন্ধু কেউ থাকেন না। এতেও থেমে থাকে না কবির জীবন, কাব্যজীবন। কবিরা পৃথিবীর সব প্রান্তে থাকেন। 

আবার তারা দৈবিক কিছুই করেন না এটাও ভুল। নিজের ন্যূনতম চাহিদা তারা পূরণ করেন। গায়ে খেটে, শাবল চালিয়ে, কোদালে মাটি তুলে তারা সমাজ বিনির্মাণ করেন। রুটি বেঁচেন, যোদ্ধা হন। ময়দানে এবং কলমেও। আর কী চায়? তারা শুধু ক্ষতির কারণ হন না। তারা এমন কিছুই দিয়ে যান না যা মানবতার বিপক্ষে যায়। বরং ইতিহাস পাঠ বলে মানবতার তরেই তাদের সবকিছু। তাদের কলম কিন্তু বন্ধুকের চেয়েও বেশি শক্তি বহন করে। কিন্তু বন্ধুক ব্যবহারকারী দুষ্ট হলে তা মানবতার বিপক্ষে যায়। কিন্তু কবিতা বা কবি মানবতার বিপক্ষে যান না। 

কবিতা ও কবিত্ব কবির কাছে সন্তানতূল্য। আর তারা প্রতিনিয়ত প্রসব করে যান। প্রসববেদনা নিয়ে পথ চলেন। কখনো তাদের দাঁড়াতে হয় বন্ধুকের নলের সামনে। কখনো তাদের দাঁড়াতে হয় পুঁজিবাদের হিংস্রতার সামনে। সব ক্রুদ্ধতা ও হিংস্রতা মাড়িয়ে কবিত্ব ও কবিতা নিয়ে তারা উদ্ধিষ্ট লক্ষে আগান। এক সময় আপাত পৃথিবী ছেড়ে চলে যান বা বিমূঢ় কিংবা নির্বাক হন। কিন্তু তার কলম চলতে থাকে। এবং তিনি বিষ্ফোরণ ঘটান। মরণের পর তাদের বিষ্ফোরণ বেশি হয়। 

এসবের মাঝেও কথা আসে সৃষ্টি, সমাজ ও মানবতার বিপক্ষে অনেক কবিকেই যেতে দেখা গেছে। ঘুরেফিরে আবার জীবনানন্দ আসেন। তারা সকলেই কবি নয়ের দলের। কবি নাম নিয়ে দৈবিক লাভ করে গেছেন। চিরজনমের আক্ষেপ নিয়ে মরেছেন, হায় কবি হতে পারলাম না! আসলে কবি হওয়ার জিনিস না।   

কথা থাকে, এমন বিরল কবিত্ব শক্তি নিয়ে কবিরা অভাব-অনটনে পর্যদুস্ত হবেন কেন? এর পিছনেও কথা থাকে। তারা অসীম ক্ষমতার কবিত্ব শক্তি ও কবিতার সংসার নিয়ে এত খুশি থাকেন যে দৈবিক ছলকলা শিখেন না। ফলে অর্থ-বিত্ত-জৌলুস তাদের আসে না। আরও বাড়িয়ে বলা যায় তারা নিজেই এসব পাওয়ার পথ সুগম করেন না। আরও এগিয়ে বলা যায় কবিদের এসব পেতে নেই! কবিত্বের জৌলুসের সঙ্গে আর কিছু যায়ও না। এবং তারা এ জৌলুসের বদলে কবিতার সংসারে সারাজীবন হালচাষ করেন, লাঙল চালান, কোদাল চাপান, বীজ বুঁনেন এবং সর্বশেষ আজন্ম লালিত ফসল পান। ফলে অন্য কিছুতে তার যাওয়া হয়ে উঠে না। করা হয়ে উঠে না চিরায়ত সংসার। পড়া হয়ে উঠে না দৃশ্যত পোশাক। খাওয়া হয়ে উঠে না গ্রাসের খাদ্য। তাদের কিছুই লাগে না। না সংসার, না ধর্ম; না জীবন। কবিত্ব তাদের ধর্ম, কাব্য তাদের সংসার, কবিতা তাদের সন্তান। এ নিয়েই পৃথিবীর আগত-অনাগত সবার ঈর্ষা ও সম্মানের পাত্র কবি। কবির সঙ্গে আর কিছু যায় কি? কবি শব্দদ্বয় কি গভীর ব্যাঞ্জনা সৃষ্টি করে না? কবির জীবন ও কাব্য সংসার; ইতিহাসের এক ব্যাঞ্জনার বিষয়। এতসব হয়ে আর কী পেতে চান কবি? 

কবি কিছু চান না। আপনি কি চান কবি ও কবিতার সংসারে আসতে? ইতিহাস কিন্তু বলে এমনই। কবি ও কবিতার সংসারেই সবাই এমনকি নারীরাও আসেন। বিপরীতে কবি কোথাও এবং কারো সংসারে যান না। তার সংসার বিশ্বসহযোগে কাব্য। আর কোথায তিনি যেতে পারেন না। আর এতসব পাওয়া, না পাওয়া, হাহাকার, ঈর্ষা, ভালোবাসা, তৃষ্ণা, ব্যাঞ্জনা নিয়েই তিনি চিরজনমের একটি গর্বের বিষয় পান কবিত্ব। আর কিছু লাগে কি!

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিজ্ঞানী ও কৃষি শ্রমিকদের অবদান রয়েছে: কৃষিমন্ত্রী
ভোটের প্রচারণায় এগিয়ে মনোজ বৈদ্য
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগে সমতা চায় টিআইবি
স্বাগতম ২০২২, বিদায় ২০২১
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি সুন্দরবন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সুবাহর শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন
তাদের মাখো মাখো ‘প্রেমের প্রাসাদ’!
‘আমাকে জায়গা দিন, এটা আমার প্রাপ্য’ : লালকেল্লার দাবিদার মোগল সম্রাজ্ঞী
চা দোকানিকে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা
আমি অনেকটাই ভেঙে পড়েছি : শামীম ওসমান
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft