হেলাল হাফিজ। তিনি আমাদের প্রিয় কবি, সচেতন আমাদের প্রিয় কবি। তাঁর কবিতা দিয়েই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়, সম্পর্ক। তাঁর কবিতা আমার খুব বেশি চেনা। যা বুঝেছেন, যা দেখেছেন, যা অনুভব করেছেন তার সত্য উচ্চারণে তিনি সাহসী ও উচ্চকণ্ঠ থেকেছেন। জীবন ও বোধের বিচিত্র চিত্রে কাব্যে ও কবিতায় কবি নিজেকে বিস্তার করেছেন, নিমজ্জিত করেছেন। তাঁর কবিতার প্রতিটি পঙক্তি তাঁকে চিনিয়ে দেয়। কবি হেলাল হাফিজ বারবার তাঁর কবিতায় টেনে আনেন প্রেম-বিরহ, বিপ্লব-স্বাধীনতা কিংবা গভীর অনুধ্যান সহকারে। তাহলেই বুঝতে পারা যায় তিনি কীসের কবি, কেমন কবি এবং কীসের জন্য; কাদের সঙ্গে তিনি সেতু গড়তে চান। কবিতাকে তিনি অবিকল মানুষের মতো ভেবেছেন। সেই কবিতা তিনি ভালোবাসার পাঠকে দিয়ে যেতে চান-‘আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো
আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।’
কবির মতে, কবিতাও মানুষের মতো সভ্যতার চাষাবাদ করে। কবিতাও চায় শিল্প আর শে¬াগানের শৈল্পিক মিলন। উদ্ধৃত চরণ দুটি কবির ‘উৎসর্গ’ কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। যে কবিতাটি কবি ১৯৮১ সালে লিখেছেন। এর দশ বছর আগে ১৯৭১ সালের এপ্রিলে লিখেছেন-
‘উত্তর পুুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই।’
(দুঃসময়ে আমার যৌবন)
কবিতা পরিচয়ে পাঠক সমীপে তিনি অখাদ্য-কুখাদ্য হাজির করতে চান না বলেই বাজারে তাঁর ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যটি ১৯৮৬ সালে প্রথম প্রকাশের পর এ পর্যন্ত অষ্টাদশ মুদ্রণ বাজারে এসেছে। ‘কবি ও কবিতায়’ লিখেছেন-
‘কবির কষ্ট দিয়ে কবিতা পুষ্ট হয়
উজ্জ্বলতা বাড়ায় বিবেক,
মানুষের নামে পরমায়ু
অমরতা উভয়ের অনুগত হয়।’
জীবনে কষ্টের যেন শেষ নেই, যুদ্ধেরও শেষ নেই। শুধু রূপ বদলায়। একাত্তরে দেশ স্বাধীন হলেও এদেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট শেষ হয়নি। তাই কবির উচ্চারণ-
‘স্বাধীনতা সব খেলো,
মানুষের দুঃখ খেলো না।’
(যেভাবে সে এলো )
একাত্তরে কবি একটি পতাকার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। কিন্তু জীবনে কিছু স্বপ্ন বাস্তব রূপ লাভ করে না। তাই কবি বেদনাহত মনে লিখেন-
‘কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমি আর লিখবো না বেদনায় অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা...
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ খামারে,
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।’
(একটি পতাকা পেলে)
পতাকা অর্জনে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সর্বস্তরের মানুষ। হায় সভ্যতা! পতাকার স্বাদ পরখ করে আজ কবিতার লুটেরা। ‘অশ্লীল সভ্যতা’ কবিতায় তাই লিখেছেন-
‘নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝা না!’
কী গভীর বিবেক জাগানিয়া পঙক্তি। দুই লাইনের কবিতাটির ভাব যেন নিউট্রন বোমার চেয়েও শক্তিশালী। এই যাঁর বোধ, তিনি কী তবে দশের সঙ্গে অশ্লীল নৃত্যে শরীক হতে পারেন? অবশ্যই না। যে কারণে তিনি মিডিয়ার পূজারী না হয়ে অকপটে বলেন-
‘আমি কি নিজেই কোনো দূর দ্বীপবাসী এক আলাদা মানুষ?
নাকি বাধ্যতামূলক আজ আমার প্রস্থান, তবে কি বিজয়ী হবে সভ্যতার অশ্লীল স্লোগান?’
(আমার কী এসে যাবে)
‘যাতায়াত’ কবিতায় তাই লিখেছেন-
‘ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়
আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর শুশ্রুষাহীন।’
এতটা পথ বেরিয়ে এসে এখনকার বাতাসও কবির বিবেচনায় অশ্লীল। যেমনটি বলেছেন ‘দুঃখের আরেক না’ কবিতায়-
‘পাখিদের নীলাকাশ বিষাক্ত হয়ে গেছে সভ্যতার অশ্লীল বাতাসে।’
অথচ কবি একদিন দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে অস্ত্র সর্মপণ করেছিলেন। কিন্তু জীবন-সময়-সমাজ বাস্তবতায় মরণাস্ত্রকে ভুলে যেতে পারেন না। প্রয়োজনে আবারো বিপ্লব চান, অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে চান শোষিতের পক্ষে। কবির ভাবনা-
‘যদি কোনোদিন আসে আবার দুর্দিন,
যেদিন ফুরাবে প্রেম অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে
ভেঙে সেই কালো কারাগার
আবার প্রণয় হবে মরণাস্ত্র তোমার আমার।’
এমন পঙক্তি পাঠান্তে মানুষ হয়ে মানুষকে খুব বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। নারীকে অনেকে ডাইনি ভাবেন। কিন্তু নারীকে হেলাল হাফিজ ভেবেছেন শৈল্পিক তাবিজ। নারীতেই তিনি পেয়েছেন সুখ। নারীকে বুকে পেয়ে তাই বলেছেন-
‘এতোদিন নারী ও রমণীহীন ছিলাম বলেই ছিলো
দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।’
(দুঃখের আরেক নাম)
কবির ‘হিরনবালা’ কবিতা পাঠে জানা যায় নারীর প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা ও ঋণ বিষয়ে-
‘নারী খেলার অভিজ্ঞতার প্রথম ও পবিত্র ঋণ
তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে সত্যি কি আর শোধ হয়েছে?’
কবি, মধুময় কিংবা পবিত্র কোনো কাজে উভয় পক্ষই পবিত্র ঋণের জটিলতায় জড়ায়। চোখে দেখা সকল নারীকে নির্ণয় করা যায় না। তাই কবি ‘অনির্ণীত নারী’ কবিতায় জানতে চেয়েছেন-
‘নারী কি চৈত্রের চিতা
নিমীলিত লীলা।’
আবার খুব কাছের নারীর কাছে জানতে চেয়েছেন-
‘এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটাই বা কষ্ট দেবে!’
(প্রস্থান)
এই যে নারী নিয়ে কবির এতো ভাবনা- প্রথমে নিশ্চয়ই নারীর প্রেমে মজেছিলেন?
হ্যাঁ। প্রেয়সীর প্রেমে মজেই বলেছেন-
‘কিছুই পারিনি দিতে
এই নাও বাম হাত তোমাকে দিলাম-বাম হাত তোমাকে দিলাম’
বাম দিয়েও নিজেকে চিনে নিতে উপায় বলে দিয়েছেন-
‘তাকানোর মতো করে তাকালেই চিনবে আমাকে’
(নাম ভূমিকায়)
কিন্তু প্রেয়সী কবিকে চিনতে পারেন না বলেই কবি উচ্চারণ করেছেন-
‘আমার যুগল চোখে ছিলো মানবিক খেলা
তুমি শুধু দেখেছো অনল।’
(অহংকার)
পুরুষের চোখে যদি নারী অনল দেখে, তাহলে বুঝি আর সেই পুরুষের বুকে নিশ্চিন্তে মাথা রাখে? মাথা রাখে না, তাই কবিমনে সৃষ্টি হয়-
‘তুমি জানো, পাড়া-প্রতিবেশী জানে পাইনি তোমাকে,
অথচ রয়েছো তুমি এই কবি সন্যাসীর ভোগে আর ত্যাগে।’
(প্রতিমা)
ভালোবাসা পেয়ে যারা ছল করে দূরে সরে যায়, কবি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন-
‘কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।’
(যাতায়াত)
তারপর কবি ফেরি করেন কষ্ট। ঘরের কষ্ট, পরের কষ্ট, চোখের বুকের নখের কষ্ট, প্রেমের ঘৃণায় নারীর কষ্ট, পথের এবং পায়ের কষ্ট। সরাসরি কবির ভাষ্য-
‘একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট...’
(ফেরীঅলা)
এতোটা কষ্টে থেকেও কবি অন্যদের সুখী দেখতে চেয়ে বলেন-
‘আমি নিপুন ব্লটিং পেপার
সব কালিমা, সকল ব্যাথা ক্ষত শুষেই নেবো’
(উপসংহার)
সবার ব্যথা শুষে নিয়ে কবি আর আহত হতে চান না-
‘এবার নিহত হবো
ওসবের কোনো কিছুতেই তবু শুধু আর আহত হবো না।’
(কবিতার কসম খেলাম)
উপরোক্ত আলোচনায় এই যে অসাধারণ কিছু পঙক্তি পাঠ করলাম, তার সবগুলো আমার নিজের কথা বলেই মনে হয়েছে। তরুণ ও বৃদ্ধের অসংখ্য খেলনা কবিতার ভিড়ে অনেকেই হেলাল হাফিজের কবিতাকে ভিন্ন আবেগ ও দরদ দিয়ে পাঠ করে। অনেকের রাত কেটে যায় তাঁর কবিতার আবৃত্তি শুনে। আসলে কবিতা লিখে তিনি কবি হতে চেয়েছিলেন, স্টার হতে চাননি। এটাই সুখের বিষয়। কবিতা যান্ত্রিক বা ফরমায়েশি কোনো বিষয় নয়, নিতান্তই হৃদয় নিঃসৃত এক বিষয়- এ সত্যের সন্ধান মিলে হেলাল হাফিজের প্রতিটি কবিতায়। পাঠকের অনুভূতির সীমাকে তিনি বাড়িয়ে দিতে পারেন। আরো পাবেন পাঠকের জীবনতত্ত্ব আর প্রাণতত্ত্বকে একাকার করে দিতে। তিনি নিমগ্ন থেকেছেন ভাষার কার্যকরণ আর শব্দ নির্বাচনে। আজকাল মিডিয়ার করুণা আশীর্বাদে অনেকেই কবি সেজে যাচ্ছেন বটে। কিন্তু হেলাল হাফিজ ভেল-ভেল্কিতে মগ্ন থাকা কেউ নন। যথার্থই কবিতার স্রষ্টাÑকবি। তাঁর কবিতা সচেতন ও মনোযোগী পাঠকের জন্য মহাবিস্ময়। অধিকাংশ কবিতায়ই তিনি পাঠককে দুর্বোধ্যতার শাসন থেকে মুক্ত রেখেছেন। যিনি কবি যে কোনো বিষয়কেই কবিতা করে তুলতে পারেন- এ সত্য খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়।
এবার কবির কিছু ইচ্ছে জেনে নেবো। জীবনে আমাদের কত ইচ্ছেই তো থাকে। কিন্তু সবার ইচ্ছে যে এক জাতের নয়। অধিকাংশের ইচ্ছেটা হয় আত্মকেন্দ্রিক। এমন বাস্তবতায় কবির ইচ্ছে-
‘মাটির সাথে মিশে গিয়ে জৈব সারে গাছ বাড়াবো
ফুল ফোটাবো, গোলাপ স্বদেশ হবে।’
(অন্যরকম সংসার)
তবে একদিন কবির ভিন্ন কিছু ইচ্ছেও ছিল-
‘ইচ্ছে ছিলো রাজা হবো
তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে রাজা আছে
ইচ্ছে আছে,
শুধু তুমি অন্য ঘরে।’
(ইচ্ছে ছিলো)
পতন দিয়ে পতন ফেরাতে চেয়ে কবি একদিন জীবনের সবুজ সকালে নদীর উল্টো জলে সাঁতার দিয়েছিলেন। যৌবনকে বাজি ধরে জীবনের অসাধারণ স্কেচ এঁকেছিলেন। আজকের ভাবনায় অফুরন্ত সম্ভবনা-
‘তবে কি মানুষ চোখে মেখেছে স্বপন
পতন দিয়েই আজ ফেরাবে পতন।’
(নিখুঁত স্ট্র্যাটেজি)
শোষিত মানুষেরা বুক টান করে ঘুরে দাঁড়াতে পারলেই কবির জয়। জয় হোক কবি ও কবিতার।
আজকালের খবর/আরইউ