প্রকাশ: রবিবার, ১৩ জুন, ২০২১, ৬:৫০ PM
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের এক নিরব ঘাতকের নাম দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র। যা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের মতো সকল উন্নয়নশীল ও অনুন্নত সকল দেশেই এই সমস্যা আজ প্রকট আকার ধারণ করেছে। সমাজে বসবাসকারী যেসব মানুষ জীবনধারনের প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না তাদের বলা হয় দরিদ্র। দারিদ্র্য প্রতিটি অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে আজ। বাংলাদেশের মতো ছোট্ট একটি দেশে দরিদ্র্যতার প্রভাব অনেকাংশে বেশি। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি আমলে শাসনের নামে যে শোষণ অব্যাহত ছিল যার ফলে পূর্ব বাংলা কখনো দরিদ্র্যতার কাল ছায়া থেকে মুক্তি পায়নি। কিন্তু তারপর স্বাধীন বাংলার অর্ধশতবছরে এসেও আমরা এর প্রকট থেকে কতটুকু বাঁচতে পেরেছি তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সময়ের পরিক্রমায় আমরা আজ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছি। যা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে এক বড় প্রাপ্তিও বটে। কিন্তু কেবল রাজধানী শহর ঢাকার দিকে লক্ষ্য করুন। ২০১৮ সালে এ শহরের শতকরা ১৭ জন লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতো। কিন্তু ২০২১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ জনে, যা প্রায় ২.৩ গুন। এই হয় যদি রাজধানী শহরের অবস্থা তাহলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবস্থা কোথায় চিন্তা করলেই বোঝা যায়। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র বলতে বুঝায় কতিপয় শক্তির একত্রীকরণ এবং একে অপরের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র সর্বপ্রথম আলোচনা করেন অধ্যাপক নার্কস। দারিদ্র্যের কারণ সম্পর্কে মিশরের রাজধানী কায়রোতে একটি বক্তৃতায় ‘দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র’ তত্ত্বের অবতারনা করেন। নার্কস বলেন, ‘ একটি দেশ দরিদ্র কারণ সে দরিদ্র।’ অর্থাৎ দরিদ্রই হচ্ছে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। আমাদের দেশের অনুন্নত কৃষি, নিরক্ষর জনগণ, পুঁজির স্বল্পতা, প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব ইত্যাদি সব সময় দুষ্টচক্রে প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খায়। অধ্যাপক নার্কস বলেন, ‘কোন দেশ দরিদ্র কারণ সে দেশে মূলধন কম কারণ সঞ্চয় কম। আবার সঞ্চয় কম হওয়ার কারণ মাথাপিছু আয় কম। মাথাপিছু আয়কম যার ফলে মাথাপিছু ভোগ কম, আর তাই শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কম। কম উৎপাদনশীলতার কারণ মাথাপিছু কম মূলধন প্রাপ্তি। কারণ মূলধনের যোগান কম।’ এভাবেই মূলধনের যোগানের দিক থেকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ব্যাখ্যা করা যায়। নিম্মে একটি সমীকরণ : কম মূলধন- কম উৎপাদন-কম আয়- কম সঞ্চয়-কম বিনিয়োগ - কম মূলধন। এভাবেই একের পর এক এই সমস্যাগুলোতে ঘুরপাক খায় আমাদের মতো দেশে। এছাড়াও আরো নানারকম সমস্যা বিদ্যমান দারিদ্রতার পেছনে। একজন মানুষ কেন সমাজে দরিদ্র শ্রেণীভুক্ত হয়; কেনইবা আরেকজন মানুষ ধনী শ্রেণীভুক্ত হয়, কিভাবে একজন মানুষ দরিদ্রসীমার আয়ের উপরে উঠতে বা নামে তা বিশ্লেষণ করলেই প্রকৃত বাস্তবতা জানা যায়। এই ঘটনাগুলোর পেছনে নানাধরনের কারন কাজ করছে এবং এক এক দরিদ্র মানুষের ইতিহাস একেক রকম হবে। দারিদ্র্যতার কারণ প্রায় দুইশত বছর ব্রিটিশ শাসন তার উত্তরসূরী হিসেবে চব্বিশ বছর পাকিস্তান শোষণ যার প্রভাব আজো বিদ্যমান কারন বাংলাদেশের এখনো বেশিভাগ সম্পদ মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বন্দি। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর না হলেও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। কিন্তু প্রয়োজনীয় মূলধন, দক্ষতা ও পরিকল্পনার অভাবে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছে না। এদেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার বড় একটি অংশ বেকার। কৃষি ও শিল্পে অনগ্রসর বলে সেখানে বিনিয়োগ কম ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। কৃষিতে নিয়োজিত অধিকাংশ মানুষ আবার ছদ্মবেকার। শহর ও নগরাঞ্চলে বেকার মানুষের মিছিল। বাংলাদেশের মানুষের পেশা হলো কৃষি কিন্তু নানা কারনে আমাদের কৃষিতে উৎপাদনশীলতা কম। উৎপাদনশীলতা কম বলে মাথাপিছু আয় কম ও জীবনযাত্রার মান নিম্ন। তার উপর ফসল নষ্ট, প্রাকৃতিক দুযোর্গ এবং কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া যুগ যুগ ধরে এদেশের কৃষকরা দরিদ্রই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের শিল্পব্যবস্থা এখনো অনুন্নত স্বাধীনতার এতো বছর পরেও বাংলাদেশে ভারী শিল্প গড়ে ওঠেনি। যার ফলে প্রচুর অর্থ আমাদের আমদানীতে চলে যায়। এবং শ্রমিকের অর্থ আত্মসাৎ করে কোটি কোটি টাকার মালিক বড়লোক। শিল্পক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে উৎপাদন না বাড়ানোর কারণে মানুষের আয়ও বাড়ে না, দারিদ্র্যতাও কাটে না। স্বল্প মজুরি বাংলাদেশের কৃষক ও শ্রমিকদের প্রদান করা হয়, যারফলে তারা প্রাপ্ত মজুরি দিয়ে কোন মতে জীবন বাঁচাতে পারলেও উন্নত জীবনযাপন স্বপ্ন দেখা যায় না। দারিদ্রতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আয় বন্টনে চরম অসমতা রয়েছে। প্রায় ৮০% সম্পদের মালিক মাত্র ২০% মানুষ। পক্ষান্তরে মাত্র ২০% সম্পদের মালিক হচ্ছে ৮০% মানুষ। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন বলতে তো শুধু ২০% মানুষের উন্নয়ন বলা যায় সাধারণ মানুষের উন্নয়ন না। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ নির্লজ্জ ভোগ বিলাসিতা করলেও অধিকাংশ মানুষ দুঃসহ নিম্নমানের জীবনযাপন করে। মূলত অসম আয় বন্টন ব্যবস্থার কারনে দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে দ্রব্য ও সেবাকর্মের মূল্য বেড়ে যায়। যারফলে সাধারণ মানুষ তার ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে যা করোনা কবলিত বাংলাদেশে পরিলক্ষিত। দুর্নীতি, কুশাসন- অপশাসন তথা সুশাসনে অভাব বাংলাদেশের দারিদ্র্যতার অন্যতম কারণ। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পরস্পর পাঁচবার বিশ্বের একনম্বর দুর্নীতি পরায়ণ দেশ হবার অগৌরব লাভ করেছে। যা বাংলাদেশের একটি লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ফেলেছে। উপরের সকল বৈশিষ্ট্যগুলো আলোকে বলা,যায় নার্কসের দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের যে উপাদান কথা বলেছিলেন যা সবগুলো পরিলক্ষিত হয় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে। তাই বলা যায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও অনুন্নত সকল দেশ অর্থনীতি দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে আছে। স্বল্প মাথাপিছু আয়, স্বল্প সঞ্চয় ও স্বল্প বিনিয়োগ, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অন্যতম প্রধান মৌলিক সমস্যা। দারিদ্র্যতা ও তার প্রতিকার: তাই বলা যায়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থেই এসব দেশের দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কারন মাথাপিছু আয় বাড়লে সঞ্চয়, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ভেঙ্গে যাবে। দরিদ্র বিমোচন প্রকল্পসমূহ দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের আয় বাড়বে। আয় বন্টন বৈষম্য দারিদ্র্যকে উৎসাহিত করে। তাই মাথাপিছু আয় ও জাতীয় আয় বাড়লেই চলবে না, সেই আয়ের বন্টন যাতে হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। কারন আয় বন্টনে সমতা আনতে পারলে ধনী ও গরীবের ব্যবধান কমে আসবে। মাথাপিছু ভোগ, সঞ্চয়, ভোগ পণ্যের চাহিদা বাড়বে, বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বাড়বে। এভাবে অর্থনীতি দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসবে। বেকারত্ব হ্রাসে শহরের পাশাপাশি গ্রামে প্রচুর বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তবে গ্রাম ও শহরে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা গেলে বেকারত্ব হ্রাস পাবে। এছাড়াও মূলধন গঠন, অবকাঠামোর উন্নয়ন, দক্ষ ও মানবসম্পদ উন্নয়ন, সামাজিক শান্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের দিকে নজর দিয়ে দক্ষ, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ব্যবস্থা বিনিময় করে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ভেঙ্গে প্রকৃত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবো। তাই শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল, ধনী থেকে গরীব সকলের মাথাপিছু আয় ও জীবনমান বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ভেদকরা সময়োপযোগী সিধান্ত। যেহেতু কাজটি কঠিন তাই দেশের সরকার ও সর্বস্তরের সকল মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। আগামীর প্রকৃত উন্নয়নশীল দেশ গড়ার প্রতিপাদ্য বিষয় হক, ‘দারিদ্র্যের কালো ছায়া ভেদ করতে হবে’।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ঢাকা কলেজ শাখা
আজকালের খবর/টিআর